পাতা:বিশ্বকোষ ঊনবিংশ খণ্ড.djvu/৪০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বঙ্গদেশ (পুরাবৃত্ত)
[৪০৫]
বঙ্গদেশ (পুরাবৃত্ত)

সবিস্ময়ে বলিয়াছিলেন, “এই পৌণ্ড্রকের কি আশ্চর্য্য বীর্য্য! কি দুঃসহ ধৈর্য্য!” যাহা হউক অতিশ্রান্ত বঙ্গবীরকে নিপাতিত করাও শ্রীকৃষ্ণের সহজসাধ্য হয় নাই। দুই বাসুদেবে বহুক্ষণ রণক্রীড়া চলিয়াছিল। অবশেষে কেশব সহস্রঅয়সংযুক্ত নিশিত চক্রদ্বারা বঙ্গাধিপকে নিপাতিত করিলেন। সেইদিন বাঙ্গালীর অপূর্ব্ব সাহস ও অসাধারণ বীরত্ব-কাহিনী পুণ্যভূমি দ্বারকায় কীর্ত্তিত হইয়াছিল। সেই বঙ্গীয় ও যাদব যুদ্ধে মহাবীর একলব্যও বঙ্গাধিপের সহিত উপস্থিত ছিলেন। তৎপরে কুরুক্ষেত্রের মহাসমরেও বঙ্গের বীরপুত্রগণ যোগদান করিয়াছিলেন, মহাভারতে তাহার উল্লেখ আছে।

 ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ অতিশয় ব্রাহ্মণভক্ত ছিলেন, এই ভক্তির কারণ তিনি ভারতীয় ব্রাহ্মণসমাজের হৃদয় আকর্ষণ করিয়াছেন এবং ভারতবাসীর পূজা পাইবার অধিকারী হইয়াছেন। কিন্তু বঙ্গীয় ক্ষত্রিয়গণের মধ্যে বহু পূর্ব্ব হইতেই এরূপ নিষ্ঠার অভাব ছিল। তাঁহারা জ্ঞানীর আদর করিতেন, কেবল লোকের সম্মান বুঝিতেন না। তাঁহারা জানিতেন যে তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষগণ অনেকে জ্ঞানবলে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়াছেন, অনেকে নিষ্কাম কর্ম্মবলে ব্রাহ্মণ হইতেও শ্রেষ্ঠ বলিয়া সম্মানিত ও দেবগণেরও পূজিত হইয়াছেন, তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষই অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গে চাতুর্বর্ণ্য-সমাজের প্রবর্ত্তক।[১]

 কর্ণপর্ব্বে মহাভারতকার লিখিয়াছেন যে, পৌণ্ড্র-মগধাদি দেশের মহাত্মারা পুরাতন শাশ্বত ধর্ম্মপালন করিয়া থাকেন। সেই শাশ্বত ধর্ম্ম কি? তাহা ঔপনিষদ ধর্ম্ম—তাহাই ব্রহ্মবিদ্যা। আমরা ছান্দোগ্যোপনিষদে পাইয়াছি যে, ব্রহ্মবিদ্যা ক্ষত্রিয়ের নিজস্ব, ক্ষত্রিয়ের নিকট হইতেই ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মবিদ্যা ও ওঁঙ্কারতত্ত্ব লাভ করেন।[২] উন্নত ক্ষত্রিয়সমাজ বেদের কর্ম্মকাণ্ডের অবশ্যকতা তত বেশী স্বীকার করিতেন না, তাঁহারা অন্তর্যজ্ঞের শ্রেষ্ঠতা ব্রাহ্মণাদিকেও শিখাইতেন।[৩] বলিতে কি অধ্যাত্মবিদ্যায় অনেক স্থলে ব্রাহ্মণেরা ক্ষত্রিয়ের নিকট পরাজিত হইয়াrছন।[৪] মিথিলায় অধ্যাত্মবিদ্যার সূত্রপাত, মগধে বিস্তৃতি এবং অঙ্গবঙ্গে পরিপুষ্টি লাভ করিয়াছিল। এ দেশের জ্ঞানিগণ বেদের মন্ত্রস্তোতা অথবা কেবল ক্রিয়াকাণ্ডপর আর্য্যকে ব্রাহ্মণ বলিয়া পূজা করিতেন না, তাঁহারা ব্রহ্মবিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিকেই ব্রাহ্মণ বলিয়া মনে করিতেন।[৫] তাঁহারা উপনিষদ্ হইতে এই ——

  1. হরিবংশ ৩১ অধ্যায় বিস্তৃত বিবরণ দ্রষ্টব্য।
  2. ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ১।৯।১, ৫।৩।৭।
  3. ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ৫।১৮।১।, কৌষীতকী উপনিষদ্ ২।৫।
  4. কৌষীতকী উপনিষদ্ ১।২-৩।
  5. বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৩।৫।১।
শিক্ষা পাইয়াছেন এবং পরবর্ত্তীকালে ক্ষত্রিয়জ্ঞানী বুদ্ধদেব তাঁহার ধম্মপদে তাহারই সমর্থন করিয়া গিয়াছেন।

 কুরুক্ষেত্রের মহাসমরে আর্য্যাবর্ত্ত হইতে ক্ষত্রিয়প্রাধান্য বিলুপ্ত ও ব্রাহ্মণপ্রাধান্য স্থাপিত হইলেও অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গে পূর্ব্বাপর ক্ষত্রিয়প্রাধান্য বিলুপ্ত হয় নাই। পূর্ব্বভারতে বুদ্ধদেব ও জৈন তীর্থঙ্করগণের আবির্ভাবে বরং ক্ষত্রিয়প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই কারণেই প্রাচীন ব্রাহ্মণসমাজ অঙ্গবঙ্গকে হীনচক্ষে দেখিতেন। জৈন ও বৌদ্ধগ্রন্থসমূহ ব্রাহ্মণ অপেক্ষা ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীর্ত্তিত।[১] ইহা যে বহুকাল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়-সংঘর্ষের ফল এবং ব্রহ্মবিদ্যার প্রভাব, তাহাতে সন্দেহ নাই।

 অনেকে মনে করিতে পারেন যে বুদ্ধ শাক্যসিংহ অথবা জৈনদিগের শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর স্বামী হইতেই ব্রাহ্মণবিরোধী মত প্রচলিত হয়। কিন্তু প্রাচীন উপনিষদ্‌গুলি আলোচনা করিলে মনে হইবে, যে বুদ্ধ বা মহাবীর প্রায় আড়াই হাজার বর্ষ পূর্ব্বে যে বোধিতত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা তাঁহাদের নিজস্ব বা কল্পিত নহে। উপনিষদেই তাহার বীজ উপ্ত হইয়াছে।[২] অষ্টক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, অঙ্গিরা, ভরদ্বাজ, বশিষ্ট, ভৃগু প্রভৃতি মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণও তাই সুপ্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে বিশেষ সম্মানিত হইয়াছেন।[৩] পূর্ব্ব ভারতে ক্ষত্রিয়প্রাধান্যের ফলেই বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম্মের অভ্যুদয়। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম্মকে যেরূপ সাধারণে অহিন্দু বলিয়া মনে করেন, আমরা সেরূপ মনে করি না। সুপ্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম্ম হিন্দু ধর্ম্মেরই অপর শাখা, ঔপনিষদধর্ম্মসম্ভূত! তাই বুদ্ধের প্রথম উপদেশে সাত্ত্বিক ও ব্রহ্মবিদ্ ব্রাহ্মণের সম্মান[৪] ও সাবিত্রীর শ্রেষ্ঠতা[৫] প্রতিপাদিত হইয়াছে। তাই আমরা শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর স্বামীকে চতুর্ব্বেদ[৬] ও সকল প্রাচীন ব্রহ্মশাস্ত্রে অধীত হইতে দেখি। তাই ব্রাহ্মণশাস্ত্র এবং ——

  1. জিনসংহিতা, ও আচারাঙ্গ সূত্র প্রভৃতি জৈন এবং মহাবগ্‌গ, অম্বট্‌ঠসূক্ত প্রভৃতি বৌদ্ধগ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
  2. বৃহদারণ্যক উপনিষদে-৬।২।৭ “শ্রমণ” এবং গৌতমধর্ম্মসূত্রে ৩।২৭ “শ্রামণ্যক” ভিক্ষুসূত্রের প্রসঙ্গ রহিয়াছে। বুদ্ধের ধম্মপদ ও আচারাঙ্গসূত্রে শ্রমণের লক্ষণ দেখ। এছাড়া আপস্তম্ব ধর্ম্মসূত্রে ২।৯।১০ ও গৌতম-ধর্ম্মসূত্রে (৩।১৮-১৯) যেরূপ ভিক্ষুদিগের কর্ত্তব্য বর্ণিত হইয়াছে, তাহার সহিত জৈন-বৌদ্ধশাস্ত্রোক্ত শ্রমণ-ধর্ম্মের কিছুমাত্র পার্থক্য নাই।
  3. মহাবগ্‌গ ৬।৩৫।২ দ্রষ্টব্য।
  4. ধম্মপদ দেখ।
  5. মহাবগ্‌গে বুদ্ধ ৰলিয়াছেন, “সকল যজ্ঞ মধ্যে অগ্নিযজ্ঞ প্রধান, সকল বেদমন্ত্র হইতে সাবিত্রী মন্ত্র প্রধান।” (মহাবগ্‌গ ৬।৩৫।৮)
  6. Jacobi's Kalpasutra (Sacred Books of the East, Vol. xxii. p. 221)