পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
৩৩

ছিল না। যে দিন হইতে শ্রীপুরের ঘরে তাহার বিয়ে হইল, সে দিনই হইতে উদয় কেমন যে হইল কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।”

 মহারাজ সুরমাকে শাসনে রাখিতে আদেশ করিয়া বাহিরে গেলেন। মহিষী উদয়াদিত্যকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। উদয়াদিত্য আসিলে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আহা, বাছা আমার রােগা, কালো হইয়া গিয়াছে! বিয়ের আগে বাছার রং কেমন ছিল! যেন তপ্ত-সােনার মত! তাের এমন দশা কে করিল? বাবা, বড় বৌ তোকে যা বলে তা’ শুনিস্ না। তার কথা শুনিয়াই তাের এমন দশা হইয়াছে।” সুরমা ঘোমটা দিয়া চুপ করিয়া এক পাশে দাঁড়াইয়াছিল। মহিষী বলিতে লাগিলেন “ওর ছােট বংশে জন্ম, ও কি তাের যােগ্য? ও কি তােক পরামর্শ দিতে জানে? আমি যথার্থ কথা বলিতেছি ও কখন তােকে ভাল পরামর্শ দেয় না তাের মন্দ হইলেই ও যেন বাঁচে! এমন রাক্ষসীর সঙ্গেও মহারাজ তাের বিবাহ দিয়াছিলেন!” মহিষী অশ্রুবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 উদয়াদিত্যের প্রশান্ত ললাটে ঘর্মবিন্দু দেখা দিল। তাঁহার মনের অধীরতা পাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে, এই নিমিত্ত তাঁহার আয়তনেত্র অন্য দিকে ফিরাইলেন।

 একজন পুরানো, বৃদ্ধ দাসী বসিয়াছিল, সে হাত নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, —“শ্রীপুরের মেয়েরা যাদু জানে। নিশ্চয় বাছাকে ওষুধ করিয়াছে।” এই বলিয়া, উঠিয়া উদয়াদিত্যের কাছে গিয়া বলিল, “বাবা, ও তােমাকে ওষুধ করিয়াছে। ঐ যে মেয়েটি দেখিতেছ, উনি বড় সামান্য মেয়ে নন! শ্রীপুরের ঘরের মেয়ে। ওরা ডাইনি! আহা বাছার শরীরে আর কিছু রাখিল না?” এই বলিয়া সে সুরমার দিকে তীরের মত এক কটাক্ষ বর্ষণ করিল ও আঁচল দিয়া দুই হস্তে দুই শুষ্ক চক্ষু রগ্‌ড়াইয়া লাল করিয়া তুলিল। তাহা দেখিয়া আবার মহিষীর দুঃখ একেবারে উথলিয়া উঠিল।