পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

 — আয় তো আমার কাছে। দ্যাখ তোর জন্যে কেমন জামা করছি।

 বিধান কাছেও আসে, জামাও দেখে কিন্তু তাহার কোনো রকম উৎসাহ দেখা যায় না।

 শ্যামা উদ্বিগ্ন হইয়া বলে — কি ভাবছিস রে তুই? কার কথা ভাবছিস?

 — কিচ্ছু ভাবছি না তো!

 — মোটরটা চালা না খোকা, মণি কেমন হাসবে দেখিস।

 বিধান মোটরে চাবি দিয়া ছাড়িয়া দেয়। মোটরটা চক্রাকারে ঘুরিয়া ওদিকের দেয়ালে ঠোক্কর খায়। শ্যামা নিজেই উচ্ছসিত হইয়া বলে — যাঃ, তোর মোটরের কলিশন হয়ে গেল! — বিধান বসিয়া থাকে, খেলনাটিকে উঠাইয়া আনিবার স্পৃহা তাহার দেখা যায় না। সেলাই বন্ধ করিয়া শ্যামা ছুঁচটি কাপড়ে বিঁধাইয়া রাখে। বিধানের হঠাৎ এমন মনমরা হইয়া যাওয়ার কোনো কারণই সে খুঁজিয়া পায় না। বুড়ো মানুষের মত একি উদাস গাম্ভীর্য অতটুকু ছেলের!

 — ক্ষিদে পেয়েছে তোর?

 বিধান মাথা নাড়ে।

 — তবে তোর ঘুম পেয়েছে খোকা। আয় আমরা শুই।

 — ঘুম পায় নি তো!

 ওরে দুর্জ্ঞেয়, তবে তোর হইয়াছে কি!

 — তবে চল, ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনি।

 সিঁড়িতে ছাদে শ্যামা অনর্গল কথা বলে। বিধানের জীবনে যত কিছু কাম্য আছে, জ্ঞানপিপাসার যত কিছু বিষয়বস্তু আছে, সব সে তাহার মনে পড়াইয়া দিতে চায়। ছেলের এই সাময়িক ও মানসিক সন্ন্যাসে শচীমাতার মতই তাহার ব্যাকুলতা জাগে। কাপড় তুলিয়া কুঁচাইয়া সে বিধানের হাতে দেয়। বিধান কাপড়গুলি নিজের দুই কাঁধে জমা করে। কাপড় তোলা শেষ হইলে শ্যামা আলিসায় ভর দিয়া রাস্তার দিকে চাহিয়া বলে, কুলপি-বরফ খাবি খোকা?

 এমনি ভাবে কথা দিয়া পূজা করিয়া, কুলপি-বরফ ঘুষ দিয়া শ্যামা ছেলের নীরবতা ভঙ্গ করে।

 বিধান জিজ্ঞাসা করে — কুলপি-বরফ কি করে তৈরি করে মা?

 শ্যামা বলে — হাতল ঘোরায় দেখিস নি? বরফ বেটে চিনি মিশিয়ে ওর ওই

৫৫