পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

দিয়াছিলেন আঠার মাস আর জরিমানা করিয়াছিলেন দু হাজার টাকা,— অনাদায়ে আরও দশ মাস কারাবাস। জরিমানা দিলে কমলবাবু অর্ধেক পাইতেন, অর্ধেক যাইত সরকারি তহবিলে। এই জরিমানার ব্যাপারটা শ্যামাকে ক’দিন বড় ভাবনায় ফেলিয়াছিল। মামা না থাকিলে সে কি করিত বলা যায় না, বকুলকে শীতল যেদিন গভীর রাত্রে ফিরাইয়া দিতে আসিয়াছিল, সেদিন দুটি ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তাদের যেন একটা অভূতপূর্ব ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়া গিয়াছিল, দুই যুগ একত্র বাস করিয়াও তাহাদেৱ যাহা আসে নাই। স্বামীর জন্য সে-রাত্রে বড় মমতা হইয়াছিল শ্যামার। কিন্তু মামা তাহকে বুঝাইয়া দিয়াছিল জরিমানার টাকা দেওয়াটা বড় বোকামির কাজ হইবে, বিশেষত বাড়ি বাঁধা না দিয়া যখন পূরা টাকাটা যোগাড় হইবে না—টাকা কই শ্যামার? হাজার টাকার নম্বর দেওয়া নোটগুলি তো এখন বাহির করা চলিবে না। বাহির করা চলিলেও আরেক হাজার টাকা?— কাজ নাই ওসব দুর্বুদ্ধি করিয়া। আঠার মাস যাকে কয়েদ খাটিতে হইবে, সে আর দশ মাস বেশি কাটাইতে পরিবে না জেলে! দশ মাসই বা কেন? বছরে ক’মাস জেল যে মকুব হয়। তারপর, শেষের চার-ছ মাস জেলে থাকিতে কয়েদীর কি আর কষ্ট হয়? তখন নামে মাত্র কয়েদী, সকালে বিকালে একবার নাম ডাকে, তারপর কয়েদীর যেখানে খুশি যায়, যা খুশি করে,— রাজার হালে থাকে।

 — বাড়িতেও তো আসতে পারে, তবে এক-আধ ঘণ্টার জন্যে?

 — না, তা পারে না, জেলের বাইরে আসতে দেয়, দুদণ্ড দাঁড়িয়ে এর ওর সঙ্গে কথা বলতে দেয়া, তাই বলে নজর কি রাখে না একেবারে? তাছাড়া কয়েদীর পোশাক পরে কোথায় যাবে?— কেউ ধরে এনে দিলে তো শেষ পর্যন্ত দাঁড়াবে, পালিয়ে যাচ্ছিল!— আবার দেবে ছ-মাস ঠুকে! জেলের কাণ্ডকারখানার কথা আর বলিস নে শ্যামা, মজার জায়গা জেল,— শীতল যত কষ্ট পাবে ভাবছিস, তা সে পাবে না, ওই প্রথম দিকে একটু যা মনের কষ্ট।

 উৎসাহের সঙ্গে গড়গড় করিয়া মামা বলিয়া যায়, অবাধ অকুণ্ঠ! কত অভিজ্ঞতাই জীবনে মামা সংগ্রহ করিয়াছে!

 শ্যামা সজল চোখে বলিয়াছিল,— এত খবর তুমি জান মামা! তুমি না থাকলে কি যে করতাম আমি, ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যেতাম!— বছরে ক’মাস কয়েদ মুকুব করে মামা? ভাল হয়ে থাকলে বোধ হয় শিগগির ছেড়ে দেয় — একদিন

১০৫