পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী > ○> আমি তার মা, আমি জািনতেও পেলাম না কি মাস কী বৃত্তান্ত? পিসি না বুকুক, তুমি তো বোঝ বাবা-মারি দুঃখু? মোহিনীকে সে বেলা এখানেই খাইয়া যাইতে হয়। জামাই কোনোদিন পর নয়, তবু আজ মোহিনী যেন বিশেষ করিয়া আপন হইয়া যায়। মনটা ভালো মোহিনীর, বকুলের জন্য টান আছে মোহিনীর, না। আসুক সে নিমন্ত্রণ না কবিলে, অবুঝ গোয়ার সে নয়, মধুর স্বভাব তার। চার-পাঁচদিন পরে বিধান গিয়া বকুলকে লইয়া আসিল। বলিল, উঃ মাগো, কী গালটা পিসি আমাকে দিলে! বাড়িতে পা-দেওয়া থেকে সেই যে বুড়ি মুখ ছুটািল মা, থামল গিয়ে একেবারে বিদায় দেবার সময়, অমঙ্গল হবে ভেবে তখন বোধ হয় কিছু বলতে সাহস হল না, মুখ গোমড়া করে দাঁডিয়ে রইল। আমি আর যাচ্ছিনে বাবু খুঁকির শ্বশুরবাড়ি এ জন্মে। বকুল তো আসিল, এ কোন বকুল? এ কী রোগা শরীর বকুলের, নিম্প্রভ কপোল, ভীরু চোখ, কান্তিবিহীন মুখ, লাবণ্যহীন বর্ণ? মেয়েকে তার এমন করিয়া দিয়াছে ওরা!—পেট ভরে খেতেও ওরা তোকে দিত না বুঝি খুকি ? খাটিয়ে মারত বুঝি তোকে দিনরাত ? আমি কি জানতাম মা এত তোকে কষ্ট দিচ্ছে! আনিবার জন্যে লিখতিস, ভাবতাম আসবার জনো মন কেমন করছে তাই ব্যাকুল হয়েছিস,--পোড়া কপাল আমার! শ্যামার মু৩২; সঠিাৎ যে খিল পড়িয়াছিল, বকুল আসিয়া যেন তা খুলিয়া দিয়াছে। সেটা আশ্চর্য নয। মনের অবস্থা অস্বাভাবিক হইয়া আসিলে এই তো তার সবার বড়ো চিকিৎসা, এমনিভাবে মশগুল হইতে পারা জীবনেব স্বাভাবিক বিপদে-সম্পদে, যার মহাসমন্বয় সংসারধর্ম। বহুদিনের দুর্ভাবনায়, বনগার পরাশ্ৰিত জীবনযাপনে শ্যামার মনে যদি বৈকল্য আসিযা তাকে, ছেলের চাকরি, অন্ধ মেয়ের জন্ম, বকুলের এ ভাবে আসিযা পড়া, এততেও সেটুকু কী শোধরাইবে না? আগের মতো হওয়া শ্যামার পক্ষে আর সম্ভব নয়, তবু পবিবর্তিত পরিশ্রান্ত ক্ষয়-পাওয়া শ্যামার মধ্যে একটু শক্তি ও উৎসাহ, একটু চাঞ্চল ও মুখবতা এখন আসিতে পারে, আসিতে পারে জীবনের হাসি-কান্নার আরও তেজি মোহ, সুখের নিবিড়ােতর স্বাদ। মহোৎসাহে শ্যামা বকুলের সেবা আরম্ভ করিল! বনগাঁয়ে চুবি করিয়া বিধানকে সে ভালো জিনিস খাওয়াইত, এখানে নিজের মুখের খাবারটুকু সে মেয়ের মুখে তুলিয়া দিতে লাগিল। নব্বুই টাকা আয়ে তো কলিকাতা শহরে রাজার হালে থাকা যায় না, নিজেকে বঞ্চিত না করিয়া মেয়েকে দিবার দুধ টুকু ঘিটুকু ফলাটুকু কোথায় পাইবে সে ? কচি মেয়ে মাই খায়, শ্যামার নিজেরও দারুণ ক্ষুধা, পাতের মাছটি তবু সে বকুলের থালায় তুলিয়া দেয়, মণিকে দিয়া চিনি পাতা দই আনায় দুপিয়সার, বলে, দই মুখে রুচিবে লো, ভাতকটা সব মেখে খেয়ে নে চেছে পুছে, লক্ষ্মী খা। দই খেলে আমার বমি আসে, তুই খাঁ তো। ও মণি, দে বাবা, একটু আচার এনে দে দিদিকে। বকুলকে সে বসাইয়া রাখে, কাজ করিতে দেয় না। দেখিতে দেখিতে বকুলের চেহারার উন্নতি হ’ ; কিন্তু মুশকিল বাধায় সরযু। বলে, মেয়েকে কাজকর্ম করতে দিচ্ছ না, এ কিন্তু ভালো নয়। ভাই। শ্যামা বলে, খেটে-খেটে সারা হয়ে এল, ওকে আর কাজ করতে দিতে মন সরে দিদি ? অল্পবিস্তর কাজ ধরতে গেলে করে বইকী মেয়ে, বিছনা-টিছানা পাতে। বিকেলে খানিকক্ষণ হেঁটেও বেড়ায় ছাতে, তা তো দেখতেই পাও? মনে হয় সরযুর অনধিকারচর্চায় শ্যামা রাগ করে। পাশকরা ধাত্রী! পাঁচটি সন্তানের জননী সে, মেয়ের কীসে ভালো কীসে মন্দ সে তা বোঝে না, পাশকরা ধাত্রী তাকে শিখাইতে আসিয়াছে!