পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

প্রখরশৃঙ্গ প্রকাণ্ড গােরুর গলার দড়িটি ধরে নিশ্চিন্ত মনে চরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তার থেকে আমাদের বাংলাদেশের নবদম্পতির চিত্র মনে পড়ল। মস্ত একটা চশমা-পরা দাড়িওয়ালা গ্র্যাজুয়েট-পুঙ্গব এবং তারই দড়িটি ধরে ছোটো একটি বারাে-তেরাে বৎসরের নােলক-পরা নববধূ― জন্তুটি দিব্যি পােষ মেনে চরে বেড়াচ্ছে, এবং মাঝে মাঝে বিস্ফারিত নয়নে কর্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত করছে।

 ট্যুরিন স্টেশনে আসা গেল। এ দেশের সামান্য পুলিশম্যানের সাজ দেখে অবাক হতে হয়। মস্ত চূড়াওয়ালা টুপি, বিস্তর জরিজরাও, লম্বা তলােয়ার, সকল ক’টিকেই সম্রাটের জ্যেষ্ঠপুত্র বলে মনে হয়। আমাদের দেশে এ রকম জমকালাে পাহারাওয়ালা থাকলে আমরা সর্বদা ডরিয়ে ডরিয়ে আরও কাহিল হয়ে যেতুম।

 দক্ষিণে বামে তুষাররেখাঙ্কিত সুনীল পর্বতশ্রেণী দেখা দিয়েছে। বামে ঘনচ্ছায়া স্নিগ্ধ অরণ্য। যেখানে অরণ্যের একটু বিচ্ছেদ পাওয়া যাচ্ছে সেইখানেই শস্যক্ষেত্র তরুশ্রেণী ও পর্বত-সমেত এক-একটা নব নব আশ্চর্য দৃশ্য খুলে যাচ্ছে। পর্বতশৃঙ্গের উপর পুরাতন দুর্গশিখর, তলদেশে এক-একটি ছােটো ছােটো গ্রাম। যত এগােচ্ছি অরণ্য পর্বত ক্রমশঃ ঘন হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে যে গ্রামগুলি আসছে সেগুলি তেমন উদ্ধত শুভ্র নবীন পরিপাটি নয়; একটু যেন ম্লান দরিদ্র নিভৃত; একটি-আধটি চর্চের চূড়া আছে মাত্র; কল-কারখানার ধুমােদ্গারী বৃংহিতধ্বনিত ঊর্ধ্বমুখী ইষ্টকশুণ্ড নেই।

 ক্রমে অল্পে অল্পে পাহাড়ের উপরে ওঠা যাচ্ছে। পার্বত্যপথ সাপের মতাে এঁকেবেঁকে চলেছে। ঢালু পাহাড়ের উপর চষা ক্ষেত সােপানের মতো থাকে থাকে উঠেছে। একটি গিরিনদী স্বচ্ছ সফেন জলরাশি নিয়ে সংকীর্ণ উপলপথ দিয়ে ঝরে পড়ছে।

 গাড়িতে আলাে দিয়ে গেল। এখনি মণ্ট্ সেনিসের বিখ্যাত

৯১