পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

প্রতিষ্ঠা করা হয়, নয় পরিবর্তনধর্মী সমাজকে অপরিবর্তনীয় ধর্মনিয়মে বদ্ধ করে নির্জীব করে দেওয়া হয়। হয় ধর্ম সর্বদাই টলমল করে, নয় সমাজ চিরকাল হ্রাসবৃদ্ধিহীন পাষাণনিশ্চলতা লাভ করে।

 আমরা কী করে খাব, কী করে শােব, কাকে ছোঁব, কাকে ছোঁব না, এর মধ্যেও যদি মানুষের যুক্তির স্বাধীনতা না থাকে— সমস্ত বুদ্ধি যদি কেবল অক্ষরে অক্ষরে শাস্ত্রীয় শ্লোকের ব্যাখ্যাতেই নিযুক্ত থাকে এবং ঈশ্বররচিত এই মহা প্রকৃতিশাস্ত্রের নিয়ম-অনুসন্ধান ও তদনুসারে চলতে চেষ্টা করাকে অনাবশ্যক জ্ঞান করা হয়, তবে এমন একটি সমাজযন্ত্র নির্মিত হয় যেখানে শাস্ত্রের চাবি দম দিচ্ছে এবং কলের পুঁতুল একান্ত বিশুদ্ধ নিয়মে চলে বেড়াচ্ছে।

 এখনি তো দেখা যায়, কথায় কথায় রব উঠছে, হিঁদুয়ানি গেল হিঁদুয়ানি গেল। কলিকাতার পথপার্শ্বস্থ প্রত্যেক গৃহভিত্তি বড়ো বড়াে অক্ষরে ঘােষণা করছে, হিঁদুয়ানি যায়! হিঁদুয়ানি যায়! বাংলা দেশের গৃহে গৃহে সভায় সভায় বক্তারা কাষ্ঠমঞ্চের উপর চড়ে জগতের কানের কাছে প্রাণপণে চীৎকার করছেন, হিঁদুয়ানি থাকে না! হিঁদুয়ানি থাকে না! ‘কী হয়েছে কী হয়েছে’ শব্দে সবাই ছুটে বেরিয়ে এল— উত্তর শুনতে পেলে বারাে বৎসরের অপরিণত বালিকাকে যদি বালিকার ভাবে না দেখতে পারাে তবে হিঁদুয়ানি আর থাকে না। প্রথাটা ভালাে কি মন্দ, সাধু কি অসাধু, মনুষ্যোচিত কি পাশব, যুক্তি এবং স্বাধীন ধর্মবুদ্ধি দ্বারা তার কোনাে মীমাংসাচেষ্টা অনাবশ্যক, কেবল কথাটা এই সে না থাকলে হিঁদুয়ানি থাকে না! তাই শুনে, হিন্দুধর্মের মহত্বের প্রতি যাদের বিশ্বাস আছে তারা লজ্জায় নতশির হয়ে রইল। শুনে, হিন্দুধর্ম এবং হিঁদুয়ানি এই দুটো শব্দকে স্বতন্ত্র জাতিতে পৃথক করে রাখতে ইচ্ছা করে।

২২