পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

কেবলই মনে হয়েছে সূর্য উঠল বলে। সেই সূর্যোদয়ের কল্পনা মাথায় করেই আমি বেরিয়েছি—তীর্থের জল নিয়ে, ফুলের সাজি সাজিয়ে। যে-দেবতাকে এতদিন সমস্ত মন দিয়ে মেনে এসেছি, মনে হয়েছে তাঁর উৎসাহ পেলুম। যেমন করে অভিসারে বেয়ােয় তেমনি করেই বেরিয়েছি। অন্ধকার রাত্রিকে অন্ধকার বলে মনেই হয় নি, আজ আলােতে চোখ মেলে অন্তরেই বা কী দেখলুম, বাইরেই বা কী দেখছি! এখন বছরের পর বছর, মুহূর্তের পর মুহূর্ত কাটবে কী করে?”

 “তুমি কি বড়ঠাকুরকে ভালােবাসতে পারবে না মনে কর?

 “পারতুম ভালােবাসতে। মনের মধ্যে এমন কিছু এনেছিলুম যাতে সবই পছন্দমতাে করে নেওয়া সহজ হত। গােড়াতেই সেইটেকে তােমার বড়ঠাকুর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আজ সব জিনিস কড়া হয়ে আমাকে বাজছে। আমার শরীরের উপরকার নরম ছালটাকে কে যেন ঘষড়ে তুলে দিল, তাই চারি দিকে সবই আমাকে লাগছে, কেবলই লাগছে; যা কিছু ছুঁই তাতেই চমকে উঠি; এর পরে কড়া পড়ে গেলে কোনাে একদিন হয়তাে সয়ে যাবে, কিন্তু জীবনে কোনােদিন আনন্দ পাব না তাে।”

 “বলা যায় না ভাই।”

 “খুব বলা যায়। আজ আমার মনে একটুমাত্র মােহ নেই। আমার জীবনটা একেবারে নির্লজ্জের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। নিজেকে একটু ভােলাবার মতাে আড়াল কোথাও বাকি রইল না। মরণ ছাড়া মেয়েদের কি আর কোথাও নড়ে বসবার একটুও জায়গা নেই? তাদের সংসারটাকে নিষ্ঠুর বিধাতা এত আঁট করেই তৈরি করেছে?”

 এতক্ষণ ধরে এমনতরাে উত্তেজনার কথা কুমুর মুখে মােতির মা আর কোনােদিন শােনে নি। বিশেষ করে আজ যেদিন বড়ঠাকুরকে ওরা কুমুর প্রতি এতটা প্রসন্ন করে এনেছে, সেইদিনই কুমুর এই তীব্র অধৈর্য দেখে

২০৬