পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Qやか○ করে দেবার জন্য সে যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে আছে, এই অন্ধকারসভায় আমাদের কাছে। এ কথাটির কোনো আভাসমাত্র সে দিচ্ছে না । আমাদের অন্তরের সন্ধ্যাকাশেও এই শ্রাবণ অত্যন্ত ঘন হয়ে নেমেছে কিন্তু সেখানে তার আপিসের বেশ নেই, সেখানে কেবল গানের আসর জমাতে, কেবল লীলার আয়োজন করতে তার আগমন । সেখানে সে কবির দরবারে উপস্থিত । তাই ক্ষণে ক্ষণে মেঘমল্লারের সুরে কেবলই করুণ গান জেগে উঠছে অথির বিজুরিক পাতিয়া । বিদ্যাপতি কহে, কৈসে গোঙায়বি হরি বিনে দিনরাতিয়া । প্ৰহরের পর প্রহর ধরে এই বার্তাই সে জানাচ্ছে, "ওরে, তুই-যে বিরহিণী- তুই বেঁচে আছিস কী করে ! তোর দিনরাত্রি কেমন করে কাটছে !” সেই চিরদিনরাত্রির হরিকেই চাই, নইলে দিনরাত্রি অনাথ । সমস্ত আকাশকে কাদিয়ে তুলে এই কথাটা আজ আর নিঃশেষ হতে চাচ্ছে না । আমরা যে তারই বিরহে এমন করে কাটাচ্ছি, এ খবরটা আমাদের নিতান্তই জানা চাই । কেননা বিরহ মিলনেরই অঙ্গ । ধোয়া যেমন আগুন জ্বলার আরম্ভ, বিরহও তেমনি মিলনের আরম্ভ-উচ্ছস । খবর আমাদের দেয় কে । ঐ-যে তোমার বিজ্ঞান যাদের মনে করছে, তারা প্ৰকৃতির কারাগারের কয়েদী, যারা পায়ে শিকল দিয়ে একজনের সঙ্গে আর-একজন বাধা থেকে দিনরাত্রি কেবল বোবার মতো কাজ করে যাচ্ছে- তারাই । যেই তাদের শিকলের শব্দ আমাদের হৃদয়ের ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করে অমনি দেখতে পাই, এ-যে বিরহের বেদনাগান, এ-যে মিলনের আহবান সংগীত ৷ যে-সব খবরকে কোনো ভাষা দিয়ে বলা যায় না, সে-সব খবরকে এরাই তো চুপি চুপি বলে যায়- এবং মানুষ কবি সেইসব খররকেই গানের মধ্যে কতকটা কথায়, কতকটা সুরে, বেঁধে গাইতে থাকে : ভরাবাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর ! আজ কেবলই মনে হচ্ছে এই—যে বর্ষা, এ তো এক সন্ধ্যার বর্ষা নয়, এ যেন আমার সমস্ত জীবনের অবিরল শ্রাবণধারা। যতদূর চেয়ে দেখি, আমার সমস্ত জীবনের উপরে সঙ্গিহীন বিরহসন্ধ্যার নিবিড় অন্ধকার— তারই দিগদিগন্তরকে ঘিরে অশ্রান্ত-শ্রাবণের বর্ষণে প্রহরের পর প্রহর কেটে যাচ্ছে ; আমার সমস্ত আকাশ ঝরঝর করে বলছে, কৈসে গোঙায়বি হরি বিনে দিনরাতিয়া।” কিন্তু তবু এই বেদনা, এই রোদন, এই বিরহ একেবারে শূন্য নয়- এই অন্ধকারের, এই শ্রাবণের বুকের মধ্যে একটি নিবিড় রস অত্যন্ত গোপনে ভরা রয়েছে ; একটি কোন বিকশিত বনের সজল গন্ধ আসছে, এমন একটি অনির্বাচনীয় মাধুৰ্য- যা যখনই প্ৰাণকে ব্যাথায় কঁাদিয়ে তুলছে, তখনই সেই বিদীর্ণ ব্যাথার ভিতর থেকে অশ্রুসিক্ত আনন্দকে টেনে বের করে নিয়ে আসছে। বিরহসন্ধ্যার অন্ধকারকে যদি শুধু এই বলে কঁদিতে হত যে, কেমন করে তোর দিনরাত্রিকাটিবে, তা হলে সমস্ত রস শুকিয়ে যেত এবং আশার অন্ধুর পর্যন্ত বীচত না- কিন্তু শুধু কেমন করে কাটবে নয় তো, কেমন করে কাটবে। হরি বিনে দিনরাতিয়া- সেইজন্যে হরি বিনে কথাটাকে ঘিরে ঘিরে এত অবিরল অজস্র বর্ষণ । চিরদিনরাত্রি যাকে নিয়ে কেটে যাবে, এমন একটি চিরজীবনের ধন কেউ আছে- তাকে না পেয়েছি নাই পেয়েছি, তবু সে আছে, সে আছে- বিরহের সমস্ত বক্ষ ভরে দিয়ে সে আছে- সেই হরি বিনে কৈসে গোঙায়বি দিনরাতিয়া । এই জীবনব্যাপী বিরহের যেখানে আরম্ভ সেখানে যিনি, যেখানে অবসান সেখানে যিনি, এবং তারই মাঝখানে গভীরভাবে প্রচ্ছন্ন থেকে যিনি করুণ সুরের বাঁশি বাজাচ্ছেন, সেই হরি বিনে কৈসে গোঙায়বি দিনরাতিয়া ।