পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૭8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আট বৎসর বয়সে বাসররাত্রে যে-শষ্যায় প্রথম শয়ন করিয়াছিল, আজ সাতাশ বৎসর পরে সেই শয্যা ত্যাগ করিল। প্রদীপ নিভাইয়া দিয়া এই সধবা রমণী যখন অসন্থ হৃদয়ভার লইয় তাহার নূতন বৈধব্যশষ্যার উপরে আসিয়া পড়িল, তখন গলির অপর প্রান্তে একজন শৌখিন যুব বেহাগ রাগিণীতে মালিনীর গান গাহিতেছিল ; আর একজন বায়া-তবলায় সংগত করিতেছিল এবং শ্ৰোতৃবন্ধুগণ সমের কাছে হাঃ-হাঃ করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেছিল। তাহার সেই গান সেই নিস্তন্ধ জ্যোৎস্নারাত্রে পার্থের ঘরে মন্দ গুনাইতেছিল না । তখন বালিকা শৈলবালার ঘুমে চোখ ঢুলিয়া পড়িতেছিল, আর নিবারণ তাহার কানের কাছে মুখ রাধিয়া ধীরে ধীরে ডাকিতেছিল, সই। লোকটা ইতিমধ্যে বঙ্কিমবাবুর চন্দ্রশেখর পড়িয়া ফেলিয়াছে এবং দুই-একজন আধুনিক কবির কাব্যও শৈলবালাকে পড়িয়া শুনাইয়াছে। নিবারণের জীবনের নিম্নস্তরে যে একটি যৌবন-উৎস বরাবর চাপ পড়িয়া ছিল, আষাত পাইয়া হঠাৎ বড়ো অসময়ে তাহা উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কেহই সেজন্ত প্রস্তুত ছিল না, এই হেতু অকস্মাৎ তাহার বুদ্ধিগুদ্ধি এবং সংসারের সমস্ত বন্দোবস্ত উলটাপালটা হইয়া গেল। সে বেচার কোনোকালে জানিত না মানুষের ভিতরে এমন সকল উপদ্রবজনক পদার্থ থাকে, এমন সকল দুর্দাম দুরন্ত শক্তি, যাহা সমস্ত হিসাবকিতাব শৃঙ্খলা-সামঞ্জস্ত একেবারে নয়ছয় করিয়া দেয়। কেবল নিবারণ নহে, হরমুন্দরও একটা নূতন বেদনার পরিচয় পাইল। এ কিসের আকাজক্ষা, এ কিসের দুঃসহ যন্ত্রণা। মন এখন যাহা চায়, কখনো তো তাহা চাহেও নাই, কখনো তো তাহা পায়ও নাই। যখন ভদ্রভাবে নিবারণ নিয়মিত আপিসে যাইত, যখন নিদ্রার পূর্বে কিয়ংকালের জন্ত গয়লার হিসাব, প্রব্যের মহার্যত এবং লৌকিকতার কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা চলিত, তখন তো এই অস্তর্বিপ্লবের কোনো স্বত্রপাতমাত্র ছিল না। ভালোবাসিত বটে, কিন্তু তাহার তো কোনো উজ্জলত কোনো উত্তাপ ছিল না। সে ভালোবাসা অপ্ৰজলিত ইন্ধনের মতো ছিল মাত্র। আজ তাহার মনে হইল, জীবনের সফলতা হইতে যেন চিরকাল কে তাহাকে বঞ্চিত করিয়া আসিয়াছে। তাহার হৃদয় যেন চিরদিন উপবাসী হইয়া আছে। তাহার এই নারীজীবন বড়ো দারিদ্র্যেই কাটিয়াছে। সে কেবল হাটবাজার পানমসলা তরিতরকারির ঝঞ্চাট লইয়াই সাতাশটা অমূল্য বংসর দাসীবৃত্তি করিয়া কাটাইল, আর আজ জীবনের মধ্যপথে আসিয়া দেখিল তাহারই শয়নকক্ষের পার্শ্বে এক গোপন মহামহৈশ্বৰ্যভাণ্ডারের কুলুপ খুলিয়া একটি ক্ষুদ্র বালিকা একেবারে রাজরাজেশ্বরী হইয়া বসিল। নারী দাসী