পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ Svo\O চক্ষু মেলিয়া চাহিতেন। যেন বলিতেন, তোমরা ভাবিয়াছ আমি ঘুমাইয়া আছি, তাহা নহে, এই দেখো আমি দিব্য জাগিয়া আছি। আমার সহিত সেই সময়ের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের আনন্দস্মৃতি বহন করিয়া আমি আপনাদের নিকট উপস্থিত হইয়াছি এবং আজ তাহার শ্ৰাদ্ধবাসরে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছি। প্রবাসী কীর্তিক ১৩২৪ S এ দেশে যে কীরূপে রাজা রামমোহনের জন্ম হইল, তাহা বুঝা যায় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা হইতে র্তাহার উৎপত্তি হয় নাই, তিনি সেই অবস্থার বহু উচ্চে অবস্থিত। অরুণচ্ছটা যেমন নিম্নভূমি অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন থাকা কালেও উন্নত পর্বতশিখরকে অনুরঞ্জিত করে, সেইরূপ স্বগীয় আলোক তঁহার উন্নত আত্মাকে আলোকিত করিয়াছিল- বিশ্বমানবের মুক্তির বাণী তাহার নিকট পৌঁছিয়াছিল। মানবজীবনে যেমন একটা সময় আছে, যখন তাহাকে গৃহের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়াই বর্ধিত হইতে হয়, বাহিরে গেলেই তাহার বিপদ, তেমনি মানবসমাজেও এরূপ শিশুকাল আছে। যে-সকল সমাজ সেরূপভাবে রক্ষিত ও বধিত হইয়াছে তাহারাই আজও বঁচিয়া আছে। কিন্তু শিশুকাল অতিক্রান্ত হইলে যেমন তাহাকে বাহিরে বিশ্বজগতের মধ্যে যাইতে হয়, তাহা না হইলে তাহার উন্নতি ও বিকাশ হইতে পারে না, তেমনি যে সমাজ চিরকাল আপনার ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে, বিশ্বমানবের সঙ্গে যুক্ত হয় না, তাহারও উন্নতি অসম্ভব হইয়া উঠে। ভারতকে বিশ্ব- মানবের সঙ্গে যুক্ত করিবার জন্যই রামমোহন আসিয়াছিলেন। শুধু ভারতের জন্য নয়, বিশ্বমানবের জন্য মুক্তির বাণী লইয়া তিনি আসিয়াছিলেন। তিনি সমগ্ৰ আদৰ্শ, সমগ্র দৃষ্টি, সমগ্র ভবিষ্যৎ আপনার মধ্যে ধরিয়াছেন। চারিদিকের অন্ধকার মধ্যে দাঁড়াইয়া যেন তিনি জুলন্ত ভাষায় বলিয়াছেন— । ‘বেদােহমেতং পুরুষং মহাস্তমাদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।' "এই অন্ধকারের পরপারস্থিত জ্যোতির্ময় মহান পুরুষকে জানিয়াছি।’ সেই মহান পুরুষকে জানিয়াই তিনি বলিয়াছিলেন, ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি— ভূমাতেই সুখ, ক্ষুদ্র সুখ নাই। আমরা ক্ষুদ্র লইয়া তৃপ্ত থাকিতে পারি না। ক্ষুদ্র দেশে আবদ্ধ থাকিলে হইবে না। দেশকে বিশ্বের অন্তর্গত করিয়া ভালোবাসিতে হইবে। সকলের মধ্যে ব্ৰহ্মাকে দেখিতে হইবে। রামমোহন যে বীজ বপন করিয়া গিয়াছেন সে-শস্য আমরা কর্তন করিব। আমরা অনেক সময় দুঃখ করি, আমাদের উপযুক্ত নেতা নাই। রামমোহনই আমাদের নেতা, আমরা তঁহারই অনুসরণ করিয়া চলি, তাহার বাণী শুনিয়া চলি। আমরা ক্ষুদ্রে ডুবিয়া থাকিতে পারি না। মহান ব্ৰহ্ম আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়দ্বারে অতিথিরূপে উপস্থিত। এই অতিথিকে স্থান দিতে হইবে। প্রত্যাখ্যান করিলে আমাদের সর্বনাশ হইবে। আমরা কেহ ছােটাে নই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যাহারা বড়ো তাহারাও চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, অহংকারী বিধ্বস্ত হইয়া গিয়াছে, আর যে ছোটাে সে বড়ো হইয়াছে। ইতিহাসে ইহার উজ্জ্বল প্রমাণ রহিয়াছে। আমরাও ছোটো নই, ছোটাে থাকিব না। সেই মহাবাণী শুনিয়া চলি, সেই নেতার অধীন হইয়া চলি, আমরাও বড়ো হইয়া উঠিব, এ দেশ বড়ো হইয়া উঠিবে। তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকা, আশ্বিন? ১৩২৪ বঙ্গাব্দ পুনমুদ্রণ, ‘প্রবাসী" কীর্তিক ১৩২৪