পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

টুই বোন ৪২৯ বলত, “তুমি প্রজাপতির মতো চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াও, কিছুই সংগ্রহ করে আন না। হতে হবে মউমাছির মতো। প্রত্যেক মুহূর্তের হিসেব অাছে। জীবনটা তো বিলাসিত নয় ।” *. নীরদ সম্প্রতি ইম্পরিয়াল লাইব্রেরি থেকে শিক্ষাতত্ত্বর বই আনিয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে, তাতে এইরকম সব কথা আছে। ওর ভাষাটা বইয়ের ভাষা, কেননা, ওর নিজের সহজ ভাষা নেই। উমির সন্দেহ রইল না যে সে অপরাধী। মহৎ ব্রত তার, অথচ তার থেকে কথায় কথায় মন আশেপাশে চলে যায় ! নিজেকে কেবলই লাঞ্ছিত করে। সামনেই দৃষ্টাস্ত রয়েছে নীরদের— কী আশ্চর্য দৃঢ়তা, কী একাগ্র লক্ষ্য, সকলপ্রকার আমোদ-আহলাদের প্রতি কী কঠোর বিরুদ্ধতা। উর্মির টেবিলে গল্প কিম্বা হালকা সাহিত্যের কোনো বই যদি দেখে তবে তখনই সেটা বাজেয়াপ্ত করে দেয় । একদিন বিকেলবেলায় উর্মির তদারক করতে এসে শুনলে সে গেছে ইংরেজি নাট্যশালায় সালিভ্যানের মিকাডে অপেরার বৈকালিক অভিনয় দেখবার জন্যে । তার দাদা থাকতে এরকম সুযোগ প্রায় বাদ যেত না । সেদিন নীরদ তাকে যথোচিত তিরস্কার করেছিল। অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে ইংরেজি ভাষায় বলেছিল, “দেখো, তোমার দাদার মৃত্যুকে সমস্ত জীবন দিয়ে সার্থক করবার ভার নিয়েছ তুমি। এরই মধ্যে কি তা ভুলতে আরম্ভ করেছ।” শুনে উর্মির অত্যন্ত পরিতাপ লাগল। ভাবলে, “এ মানুষটার কী অসাধারণ অন্তরভৃষ্টি । শোকস্থতির প্রবলতা সত্যই তো কমে আসছে— আমি নিজে তা বুঝতে পারি নি। ধিকৃ, এত চাপল্য আমার চরিত্রে | সতর্ক হতে লাগল, কাপড়-চোপড় থেকে শোভার আভাস পর্যন্ত দূর করলে। শাড়িটা হল মোটা, তার রঙ সব গেল ঘুচে। দেরাজের মধ্যে জমা থাকা সত্ত্বেও চকোলেট খাওয়ার লোভটাকে দিলে ছেড়ে । অবাধ্য মনটাকে খুব কষে বাধতে লাগল সংকীর্ণ গণ্ডিতে, শুষ্ক কর্তব্যের খোটায়। দিদি তিরস্কার করে, শশাঙ্ক নীরদের উদ্দেশে যে-সব প্রখর বিশেষণ বর্ষণ করে সেগুলোর ভাষা অভিধানবহিভূত উগ্র পরদেশীয়, একটুও স্বশ্ৰাব্য নয়। একটা জায়গায় নীরদের সঙ্গে শশাঙ্কের মেলে। শশাঙ্কের গাল দেবার আবেগ যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন তার ভাষাটা হয় ইংরেজি, নীরদের যখন উপদেশের বিষয়ট হয় অত্যন্ত উচ্চশ্রেণীর ইংরেজিই হয় তার বাহন । নীরদের সব চেয়ে খারাপ লাগে যখন নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণে উমি তার দিদির ওখানে যায়। শুধু যায় তা নয়, যাবার ভারি আগ্রহ । ওদের সঙ্গে উর্মির যে আত্মীয়সম্বন্ধ সেটা নীরদের সম্বন্ধকে খণ্ডিত করে । *