পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বিধু। কেন করব না। তাকে কি চাষা করব । এই বলিয়া বিধু ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন । বিধুর বিধবা জা পাশের ঘরে বসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া মনে করিলেন, স্বামী-স্ত্রীতে বিরলে প্ৰেমালাপ হইয়া গেল । তৃতীয় পরিচ্ছেদ মন্মথ ! ও কী ও, তোমার ছেলেটিকে কী মাখিয়েছ । বিধু । মুছা যেয়ে না, ভয়ানক কিছু নয়, একটুখানি এসেন্স মাত্র । তাও বিলাতি নয়- তোমাদের সাধের দিশি ; মন্মথ ; আমি তোমাকে বার বার বলেছি, ছেলেদের তুমি এ-সমস্ত শৌখিন জিনিস অভ্যাস করাতে পারবে না । বিধু ! আচ্ছা, যদি তোমার আরাম বোধ হয় তো কাল হতে কেরোসিন এবং ক্যাস্টর অয়েল মাখিব । মন্মথ । সেও বাজে খরচ হবে । যেটা না হলেও চলে সেটা না অভ্যাস করাই ভালো । কেরোসিন, ক্যাস্টর অয়েল, গায় মাথায় মাখা আমার মতে অনাবশ্যক । বিধু ! তোমার মতে আবশ্যক জিনিস কটা আছে তা তো জানি না, গোড়াতেই আমাকে বোধ হয় বাদ দিয়ে বসতে হয় । মন্মথ । তোমাকে বাদ দিলে যে বাদপ্রতিবাদ একেবারেই বন্ধ হবে । এতকালের দৈনিক অভ্যাস হঠাৎ ছাড়লে এ বয়সে হয়তো সহ্য হবে না । যাই হােক, এ কথা আমি তোমাকে আগে হতে বলে রাখছি, ছেলেটিকে তুমি সাহেব কর বা নবাব কর বা সাহেবি-নিবাবির খিচুড়ি পাকাও তার খরচ আমি জোগাব না। আমার মৃত্যুর পরে সে যা পাবে তাতে তার শখের খরচ কুলোবে না । বিধু । সে আমি জানি । তোমার টাকার উপরে ভরসা রাখলে ছেলেকে কোপনি পরানো অভ্যাস করাতেমা । বিধুর এই অবজ্ঞাবাক্যে মর্মাহত হইয়াও মন্মথ ক্ষণকালের মধ্যে সামলাইয়া লইলেন ; কহিলেন, “আমিও তা জানি । তোমার ভগিনীপতি শশধরের 'পরেই তোমার ভরসা । তার সন্তান নেই বলে ঠিক করে বসে আছ, তোমার ছেলেকেই সে উইলে সমান্ত লিখে পড়ে দিয়ে যাবে । সেইজন্যই যখন-তখন ছেলেটাকে ফিরিঙ্গি সাজিয়ে এক-গা গন্ধ মাখিয়ে তার মেসোর আদর কাড়বার জন্য পাঠিয়ে দাও । আমি দারিদ্র্যের লজ্জা অনায়াসেই সহ্য করতে পারি, কিন্তু ধনী কুটুম্বের সোহাগ-যাচনার লজা আমার अश श्ख्न क्रा |" এ কথা মন্মথর মনে অনেকদিন উদয় হইয়াছে, কিন্তু কথাটা কঠোর হইবে বলিয়া এ পর্যন্ত কখনো বলেন নাই। বিধু মনে করিতেন, স্বামী তাহার গৃঢ় অভিপ্রায় ঠিক বুঝিতে পারেন নাই, কারণ স্বামী সম্প্রদায় স্ত্রীর মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে অপরিসীম মূর্থি। কিন্তু মন্মথ যে বসিয়া বসিয়া ঠাহর ঢাল ধরিতে পারিয়াছেন, হঠাৎ জানিতে পারিয়া বিধুর পক্ষে মর্মান্তিক হইয়া উঠিল। মুখ লাল করিয়া বিধু কহিলেন, “ছেলেকে মাসির কাছে পাঠালেও গায়ে সয় না, এতবড়ো মানী লোকের ঘরে আছি সে তো পূর্বে বুঝতে পারি নি।” এমন সময় বিধবা জা প্ৰবেশ করিয়া কহিলেন, “মেজবাউ, তোদের ধন্য । আজি সতেরো বৎসর হয়ে গেল তবু তোদের কথা ফুরালো না। রাত্রে কুলায় না, শেষকালে দিনেও দুইজনে মিলে ফিসফিস । তোদের জিকের আগায় বিধাতা এত মধু দিনরাত্ৰি জোগান কোথা হতে আমি তাই ভাবি । রাগ কোরো না ঠাকুরপো, তোমাদের মধুরালাপে ব্যাঘাত করব না, একবার কেবল দু মিনিটের জন্য মেজবাউয়ের কাছ হতে সেলাইয়ের প্যাটার্নটা দেখিয়ে নিতে এসেছি।”