পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 VeSR রবীন্দ্র-রচনাবলী মালের কোনো কিনারা হইল না। এরূপ লোকসান অধরলালের পক্ষে অসহ্য । তিনি পৃথিবীসুন্ধ লোকের উপর চটিয়া উঠিলেন। রতিকান্ত কহিল, “বাড়িতে অনেক লোক রহিয়াছে, কাহাকেই বা দোষ দিবেন, কাহাকেই বা সন্দেহ করবেন । যাহার যখন খুশি আসিতেছে। যাইতেছে।” অধরলাল মাস্টারকে ডাকাইয়া বলিলেন, “দেখে হরলাল, তোমাদের কাহাকেও বাড়িতে রাখা আমার পক্ষে সুবিধা হইবে না। এখন হইতে তুমি আলাদা বাসায় থাকিয়া বেণুকে ঠিক সময়মত পড়াইয়া যাইবে, এই হইলেই ভালো হয়- নাহয় আমি তোমার দুই টাকা মাইনে বৃদ্ধি করিয়া দিতে রাজি আছি ।” V রতিকান্ত তামাক টানিতে টানিতে বলিল, “এ তো অতি ভালো কথা- উভয়পক্ষেই ভালো ।” হরলাল মুখ নিচু করিয়া শুনিল। তখন কিছু বলিতে পারিল না। ঘরে আসিয়া অধরবাবুকে চিঠি লিখিয়া পাঠাইল, নানা কারণে বেণুকে পড়ানো তাহার পক্ষে সুবিধা হইবে না- অতএব আজই সে বিদায় গ্ৰহণ করিবার জন্য প্ৰস্তুত হইয়াছে । সেদিন বেণুইস্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, মাস্টারমশায়ের ঘর শূন্য। তাহার সেই ভগ্নপ্রায় টিনের পেটরাটিও নাই। দড়ির উপর তাহার চাদর ও গামছা কুলিত, সে দড়িটা আছে, কিন্তু চাদর ও গামছা নাই । টেবিলের উপর খাতাপত্র ও বই এলোমেলো ছড়ানো থাকিত, তাহার বদলে সেখানে একটা বড়ো বোতলের মধ্যে সোনালি মাছ ঝকঝাক করিতে করিতে ওঠানামা করিতেছে । বোতলের গায়ের উপর মাস্টারমশায়ের হস্তাক্ষরে বেণুর নাম লেখা একটা কাগজ আঁটা । আর-একটি নূতন ভালো বাধাই করা ইংরেজি ছবির বই, তাহার ভিতরকার পাতায় এক প্রান্তে বেণুর নাম ও তাহার নীচে আজকের তারিখ মাস ও সন দেওয়া আছে । বেণু চুটিয়া তাহার বাপের কাছে গিয়া কহিল, “বাবা, মাস্টারমশায় কোথায় গেছেন।” বাপ তাহাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “তিনি কাজ ছাডিয়া দিয়া চলিয়া গেছেন।” বেণু বাপের হাত ছাড়াইয়া লইয়া পাশের ঘরে বিছানার উপরে উপুড় হইয়া পড়িয়া কঁদিতে লাগিল। অধরবাবু ব্যাকুল হইয়া কী করবেন কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। পরদিন বেলা সাড়ে দশটার সময় হরলাল একটা মেসের ঘরে তক্তপোশের উপর উন্মনা হইয়া বসিয়া কলেজে যাইবে কি না ভাবিতেছে এমন সময় হঠাৎ দেখিল প্ৰথমে অধরবাবুদের দরোয়ান ঘরে প্রবেশ করিল এবং তাহার পিছনে বেণু ঘরে ঢুকিয়াই হরলালের গলা জড়াইয়া ধরিল। হরলালের গলার স্বর আটকাইয়া গেল ; কথা কহিতে গেলেই তাহার দুই চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িবে এই ভয়ে সে কোনো কথাই কহিতে পারিল না । বেণু কহিল, “মাস্টারমশায়, আমাদের বাড়ি চলো ।” বেণু তাহদের বৃদ্ধ দরোয়ান চন্দ্ৰভানকে ধরিয়া পড়িয়াছিল, যেমন করিয়া হউক, মাস্টারমশায়ের বাড়িতে তাহাকে লইয়া যাইতে হইবে। পাড়ার যে মুটি হরলালের পেটরা বহিয়া আনিয়াছিল তাহার কাছ হইতে সন্ধান লইয়া আজ ইস্কুলে যাইবার গাড়িতে চন্দ্রভান বেণুকে হরলালের মেসে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে । কেন যে হরলালের পক্ষে বেণুদের বাড়ি যাওয়া একেবারেই অসম্ভব তাহা সে বলিতেও পারিল না, অথচ তাহদের বাড়িতেও যাইতে পারিল না। বেণু যে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে বলিয়াছিল “আমাদের বাড়ি চলো”— এই স্পর্শ ও এই কথাটার স্মৃতি কত দিনে কত রাত্রে তাহার কণ্ঠ চাপিয়া ধরিয়া যেন তাহার নিশ্বাস রোধ করিয়াছে’- কিন্তু ক্রমে এমনও দিন আসিল যখন দুই পক্ষেই মুচুকীয়া গেল— বন্ধের পর আকড়াইয়া ধরিয়া কােন নিশাচর বাস্থলে মতাে আর বুলিয়া R | Vé হরলাল অনেক চেষ্টা করিয়াও পড়াতে আর তেমন করিয়া মনোযোগ করিতে পারিল না । সে কোনোমতেই স্থির হইয়া পড়িতে বসিতে পারিত না । সে খানিকটা পড়িবার চেষ্টা করিয়াই ধা’করিয়া