পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি \ტაჯა ঘোমটার ভিতর হইতে আশার দুই চক্ষু আবার ভৎসনা বর্ষণ করিল। বিহারী কহিল, “বিদায় করিলেও ফিরিতে কতক্ষণ। বিধবার বিবাহ দিয়া দাও — বিষদাত একেবারে ভাঙিবে ।” মহেন্দ্র । কুন্দরও তো বিবাহ দেওয়া হইয়াছিল । বিহারী কহিল, “থাক, ও উপমাটা এখন রাখে। বিনোদিনীর কথা আমি মাঝে মাঝে ভাবি । তোমার এখানে উনি তো চিরদিন থাকিতে পারেন না । তাহার পরে, যে বন দেখিয়া আসিয়াছি সেখানে উহাকে যাবজ্জীবন বনবাসে পাঠানো, সেও বড়ো কঠিন দণ্ড ।” মহেক্সের সম্মুখে এ পর্যস্ত বিনোদিনী বাহির হয় নাই, কিন্তু বিহারী তাহাকে দেখিয়াছে। বিহার এটুকু বুঝিয়াছে, এ নারী জঙ্গলে ফেলিয়া রাখিবার নহে। কিন্তু শিখা এক ভাবে ঘরের প্রদীপরূপে জলে, আর-এক ভাবে ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়— সে আশঙ্কাও বিহারীর মনে ছিল । মহেন্দ্র বিহারীকে এই কথা লইয়া অনেক পরিহাস করিল। বিহারীও তাহার জবাব দিল । কিন্তু তাহার মন বুঝিয়াছিল, এ-নারী খেলা করিবার নহে, ইহাকে উপেক্ষা করাও যায় না । রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে সাবধান করিয়া দিলেন । কহিলেন, “দেখো বাছা, বউকে লইয়া তুমি অত টানাটানি করিয়ো না । তুমি পাড়াগায়ের গৃহস্থ-ঘরে ছিলে— আজকালকার চালচলন জান না। তুমি বুদ্ধিমতী, ভালো করিয়া বুঝিয়া চলিয়ে ।” ইহার পর বিনোদিনী অত্যস্ত আড়ম্বরপূর্বক আশাকে দূরে দূরে রাখিল কহিল, “আমি ভাই কে । আমার মতো অবস্থার লোক আপন মান বঁাচাইয়া চলিতে না জানিলে, কোন দিন কী ঘটে, বলা যায় কি ” আশা সাধাসাধি কাম্নাকাটি করিয়া মরে— বিনোদিনী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনের কথায় আশা আকণ্ঠ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু বিনোদিনী আমল দিল না। এদিকে মহেক্সের বাহপাশ শিথিল এবং তাহার মুগ্ধদৃষ্টি যেন ক্লাস্তিতে আবৃত হইয়া আসিয়াছে। পূর্বে যে-সকল অনিয়ম-উচ্ছ স্থলা তাহার কাছে কৌতুকজনক বোধ হইত, এখন তাহা অল্পে অল্পে তাহাকে পীড়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছে । আশার সাংসারিক অপটুতায় সে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, কিন্তু প্রকাশ করিয়া বলে না। প্রকাশ না করিলেও অাশা অন্তরে অস্তরে অনুভব করিয়াছে, নিরবচ্ছিন্ন মিলনে প্রেমের মর্যাদা মান হইয়া যাইতেছে । মহেঞ্জের সোহাগের মধ্যে বেস্থর লাগিতেছিল – কতকটা মিথ্যা বাড়াবাড়ি, কতকটা আত্মপ্রতারণা ।