পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি । HLA রন্ধন প্রায় শেষ হইলে পর বিনোদিনী কহিল, “মহিনবাবু, আপনি ঐ বটের পাতা গনিয়া শেষ করিতে পারিবেন না, এবারে স্নান করিতে যান ।” ভূত্যের দল এতক্ষণে জিনিসপত্র লইয়া উপস্থিত হইল । তাহদের গাড়ি পথের মধ্যে ভাঙিয়া গিয়াছিল। তখন বেলা দুপুর হুইয়া গেছে। © আহারাস্তে সেই বটগাছের তলায় তাস খেলিবার প্রস্তাব হইল— মহেন্দ্র কোনোমতেই গা দিল না এবং দেখিতে দেখিতে ছায়াতলে ঘুমাইয়া পড়িল। আশা বাড়ির মধ্যে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া বিশ্রামের উদযোগ করিল। বিনোদিনী মাথার উপরে একটুখানি কাপড় তুলিয়া দিয়া কহিল, “আমি তবে ঘরে যাই ।” বিহারী কহিল, “কোথায় যাইবেন, একটু গল্প করুন। আপনাদের দেশের কথা বলুন ।” ক্ষণে ক্ষণে উষ্ণ মধ্যাহ্নের বাতাস তরুপল্লব মর্মরিত করিয়া চলিয়া গেল, ক্ষণে ক্ষণে দিঘির পাড়ে জামগাছের ঘনপত্রের মধ্য হইতে কোকিল ডাকিয়া উঠিল। বিনোদিনী তাহার ছেলেবেলাকার কথা বলিতে লাগিল, তাহার বাপমায়ের কথা, তাহার বাল্যসাথির কথা। বলিতে বলিতে তাহার মাথা হইতে কাপড়টুকু খসিয়া পড়িল ; বিনোদিনীর মুখে খরযৌবনের যে একটি দীপ্তি সর্বদাই বিরাজ করিত, বাল্যস্থতির ছায়া আসিয়া তাহাকে স্নিগ্ধ করিয়া দিল। বিনোদিনীর চক্ষে যে কৌতুকতীব্র কটাক্ষ দেখিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টি বিহারীর মনে এ-পর্যন্ত নানাপ্রকার সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল, সেই উজ্জলকৃষ্ণ জ্যোতি যখন একটি শাস্তসজল রেখায় স্নান হইয়া আসিল তখন বিহারী যেন আর-একটি মানুষ দেখিতে পাইল । এই দীপ্তিমণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে কোমল হৃদয়টুকু এখনো স্বধাধারায় সরস হইয়া আছে, অপরিতৃপ্ত রঙ্গরস কৌতুকবিলাসের দহনজালায় এখনো নারীপ্রকৃতি শুষ্ক হইয়া যায় নাই । বিনোদিনী সলজ্জ সতীন্ত্রীভাবে একাস্ত-ভক্তিভরে পতিসেবা করিতেছে, কল্যাণপরিপূর্ণ জননীর মতো সস্তানকে কোলে ধরিয়া আছে, এ ছবি ইতিপূর্বে মুহূর্তের জন্যও বিহারীর মনে উদিত হয় নাই— আজ যেন রঙ্গমঞ্চের পটখানা ক্ষণকালের জন্ত উড়িয়া গিয়া ঘরের ভিতরকার একটি মঙ্গলদৃপ্ত তাহার চোখে পড়িল । বিহারী ভাবিল, “বিনোদিনী বাহিরে বিলাসিনী যুবতী বটে, কিন্তু তাহার অস্তরে একটি পূজারত নারী নিরশনে তপস্যা করিতেছে।” বিহারী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিল, “প্রকৃত-আপনাকে মানুষ আপনিও জানিতে পারে না, অন্তর্যামীই জানেন ; অবস্থাবিপাকে যেটা বাহিরে গড়িয়া উঠে ংসারের কাছে সেইটেই সত্য ।” বিহারী কথাটাকে থামিতে দিল না,— প্রশ্ন করিয়া