পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি \లి\9:S আঘাতে বিহারীকে যে দূরে লইয়া গেছে, সে যেন ভালোই হইয়াছে— বিনোদিনী যেন নিশ্চিন্ত হইল । কিন্তু বিহারীর সেই মৃত্যুবাণাহত রক্তহীন পাংশু মুখ বিনোদিনীকে সকল কর্ষের মধ্যে যেন অমুসরণ করিয়া ফিরিল । বিনোদিনীর অন্তরে যে সেবাপরায়ণ নারীপ্রকৃর্তি ছিল, সে সেই আর্ত মুখ দেখিয়া কাদিতে লাগিল । রুগ্ন শিশুকে যেমন মাতা বুকের কাছে দোলাইয়া বেড়ায়, তেমনি সেই আতুর মূর্তিকে বিনোদিনী আপন হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়া দোলাইতে লাগিল ; তাহাকে স্বস্থ করিয়া সেই মুখে আবার রক্তের রেখা, প্রাণের প্রবাহ, হাস্তের বিকাশ দেখিবার জন্য বিনোদিনীর একটা অধীর ঔৎসুক্য জন্মিল । দুই-তিন দিন সকল কর্মের মধ্যে এইরূপ উন্মনা হইয়া ফিরিয়া বিনোদিনী আর থাকিতে পারিল না । বিনোদিনী একখানি সাত্বনার পত্র লিথিল, কহিল— ঠাকুরপো, আমি তোমার সেদিনকার সেই শুষ্ক মুখ দেখিয়া অবধি প্রাণমনে কামনা করিতেছি, তুমি স্বস্থ হও, তুমি যেমন ছিলে তেমনিটি হও— সেই সহজ হাসি আবার কবে দেখিব, সেই উদার কথা আবার কবে শুনিব । তুমি কেমন আছ, আমাকে একটি ছত্র লিখিয়া জানাও । তোমার বিনোদ-বোঠান । বিনোদিনী দরোয়ানের হাত দিয়া বিহারীর ঠিকানায় চিঠি পাঠাইয়া দিল । আশাকে বিহারী ভালোবাসে, এ-কথা যে এমন রূঢ় করিয়া, এমন গহিত ভাবে মহেন্দ্র মুখে উচ্চারণ করিতে পারিবে, তাহা বিহারী স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই । কারণ, সে নিজেও এমন কথা স্পষ্ট করিয়া কখনো মনে স্থান দেয় নাই । প্রথমট বজাহত হইল— তার পরে ক্রোধে ঘৃণায় ছটফট করিয়া বলিতে লাগিল, “অন্যায়, অসংগত, অমূলক ।” কিন্তু কথাটা যখন একবার উচ্চারিত হইয়াছে, তখন তাহাকে আর সম্পূর্ণ মারিয়া ফেলা যায় না । তাহার মধ্যে যেটুকু সত্যের বীজ ছিল, তাহ দেখিতে দেখিতে অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতে লাগিল । কন্যা দেপিবার উপলক্ষে সেই যে একদিন স্বৰ্ষান্তকালে বাগানের উচ্ছসিত পুষ্পগন্ধপ্রবাহে লজ্জিতা বালিকার স্বকুমার মুখখানিকে সে নিতান্তই আপনার মনে করিয়া বিগলিত অনুরাগের সহিত একবার চাহিয়া দেখিয়াছিল, তাহাই বার বার মনে পড়িতে লাগিল, এবং বুকের কাছে কী যেন চাপিয়া ধরিতে লাগিল, এবং একটা অত্যন্ত কঠিন বেদনা কণ্ঠের কাছ পর্যন্ত আলোড়িত হইয়। উঠিল । দীর্ঘরাত্রি ছাদের উপর শুইয়া শুইয়া বাড়ির সম্মুখের পথে দ্রুতপদে পায়চাৰি