পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՓԳ օ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিতে করিতে, যাহা এতদিন অব্যক্ত ছিল তাহ বিহারীর মনে ব্যক্ত হইয়া উঠিল । যাহা সংঘত ছিল তাহা উদাম হইল ; নিজের কাছেও যাহার কোনো প্রমাণ ছিল না, মহেঞ্জের বাক্যে তাহা বিরাট প্রাণ পাইয়া বিহারীর অন্তর-বাহির ব্যাপ্ত করিয়া দিল । তখন সে নিজেকে অপরাধী বলিয়া বুঝিল । মনে মনে কহিল, “আমার তো আর রাগ করা শোভা পায় না, মহেন্দ্রের কাছে তো ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বিদায় লইতে হইবে । সেদিন এমনভাবে চলিয়া আসিয়াছিলাম, যেন মহেন্দ্র দোষী, আমি বিচারক —সে-অন্যায় স্বীকার করিয়া আসিব ।” বিহারী জানিত, আশা কাশী চলিয়া গেছে । এক দিন সে সন্ধ্যার সময় ধীরে ধীরে মহেঞ্জের দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজলক্ষ্মীর দূরসম্পর্কের মামা সাধুচরণকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সাধদা, ক-দিন আসিতে পারি নাই— এখানকার সব খবর ভালো ?” সাধুচরণ সকলের কুশল জানাইল । বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “বোঠান কাশীতে কবে গেলেন।” সাধুচরণ কহিল, “তিনি যান নাই । তাহার কাশী যাওয়া হইবে না।” শুনিয়া, কিছু না মানিয়া অন্তঃপুরে যাইবার জন্য বিহারীর মন ছুটিল। পূর্বে যেমন সহজে যেমন আনন্দে আত্মীয়ের মতো সে পরিচিত সিড়ি বাহিয়া ভিতরে যাইত, সকলের সঙ্গে স্নিগ্ধ কৌতুকের সহিত হাস্যালাপ করিয়া অসিত, কিছুই মনে হইত না, আজ তাহা অবিহিত, তাহা দুর্লভ, জানিয়াই তাহার চিত্ত যেন উন্মত্ত হইল। আর-একটিবার, কেবল শেষবার, তেমনি করিয়া ভিতরে গিয়া ঘরের ছেলের মতো রাজলক্ষ্মীর সহিত কথা সারিয়া, একবার ঘোমটাৰ্বত জাপাকে বোঠান বলিয়া দুটো তুচ্ছ কথা কহিয়া আসা তাহার কাছে পরম আকাঙ্ক্ষার বিষয় হইয়া উঠিল । সাধুচরণ কহিল, “ভাই, অন্ধকারে দাড়াইয়া রহিলে যে, ভিতরে চলো ।” শুনিয়া বিহারী দ্রুতবেগে ভিতরের দিকে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াই ফিরিয়া সাধুকে কহিল, “যাই একটা কাজ আছে।" বলিয়া তাড়াতাড়ি প্রস্থান করিল। সেই রাত্রেই বিহারী পশ্চিমে চলিয়া গেল । দরোয়ান বিনোদিনীর চিঠি লইয়া বিহারীকে না পাইয়া চিঠি ফিরাইয়া লইয়া আসিল । মহেন্দ্র তখন দেউড়ির সম্মুখে ছোটো বাগানটিতে বেড়াইতেছিল। জিজ্ঞাসা করিল, “এ কাহার চিঠি ।” দরোয়ান সমস্ত বলিল। মহেন্দ্র চিঠিখানি मिट्छ लझेल । একবার সে ভাবিল, চিঠিখানা লইয়া বিনোদিনীর হাতে দিবে—অপরাধিনী বিনোদিনীর লজ্জিত মুখ একবার সে দেখিয়া আসিবে—কোনো কথা বলিবে না।