পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8X S খোলা চিঠি বাহির করিবামাত্র দেখিল, বিনোদিনীর হস্তাক্ষর। চকিতের মধ্যে আশার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। চিঠি হাতে লইয়া সে পাশের ঘরে গিয়া পড়িল— কাল রাত্রে তুমি যে-কাগুটা করিলে, তাহাতেও কি তোমার তৃপ্তি হইল না। আজ আবার কেন খেমির হাত দিয়া আমাকে গোপনে চিঠি পাঠাইলে । ছিছি, সে কী মনে করিল। আমাকে তুমি কি জগতে কাহারও কাছে মুখ দেখাইতে দিবে না। আমার কাছে কী চাও তুমি। ভালোবাসা ? তোমার এ ভিক্ষাবৃত্তি কেন। জন্মকাল হইতে তুমি কেবল ভালোবাসাই পাইয়া আসিতেছ, তবু তোমার লোভের অন্ত নাই ! জগতে আমার ভালোবাসিবার এবং ভালোবাসা পাইবার কোনো স্থান নাই। তাই আমি খেলা খেলিয়া ভালোবাসার খেদ মিটাইয়া থাকি । যখন তোমার অবসর ছিল তখন সেই মিথ্যা খেলায় তুমিও যোগ দিয়াছিলে । কিন্তু খেলার ছুটি কি ফুরায় না। ঘরের মধ্যে তোমার ডাক পড়িয়াছে, এখন আবার খেলার ঘরে উকিঝু কি কেন। এখন ধুলা ঝাড়িয়া ঘরে যাও । আমার তো ঘর নাই, আমি মনে মনে একলা বসিয়া খেলা করিব, তোমাকে ডাকিব না । তুমি লিখিয়াছ, আমাকে ভালোবাস । খেলার বেলায় সে-কথা শোনা যাইতে পারে— কিন্তু যদি সত্য বলিতে হয়, ও-কথা বিশ্বাস করি না । এক সময় মনে করিতে, তুমি আশাকে ভালোবাসিতেছ, সেও মিথ্যা ; — এখন মনে করিতেছ, তুমি আমাকে ভালোবাসিতেছ, এও মিথ্যা। তুমি কেবল নিজেকে ভালোবাস । ভালোবাসার তৃষ্ণায় আমার হৃদয় হইতে বক্ষ পর্যন্ত শুকাইয়া উঠিয়াছে— সে তৃষ্ণ পূরণ করিবার সম্বল তোমার হাতে নাই, সে আমি বেশ ভালো করিয়াই দেখিয়াছি। আমি তোমাকে বারংবার বলিতেছি, তুমি আমাকে ত্যাগ করো, আমার পশ্চাতে ফিরিয়ো না ; নির্লজ্জ হইয়া আমাকে লজ্জা দিয়ে না। আমার খেলার শখও মিটিয়াছে ; এখন ডাক দিলে কিছুতেই আমার সাড়া পাইবে না। চিঠিতে তুমি আমাকে নিষ্ঠুর বলিয়াছ— সে-কথা সত্য হইতে পারে ; কিন্তু আমার কিছু দয়াও আছে– তাই আজ তোমাকে আমি দয়া করিয়া ত্যাগ করিলাম। এ-চিঠির যদি উত্তর দাও তবে বুঝিব, না পালাইলে তোমার হাত হইতে আমার আর নিষ্কৃতি নাই।