পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 8لاوائ করিবার জন্য গুপ্তচরের কাজ করিতেছি, মাতৃভূমির বিরুদ্ধে হাত তুলিতেছি এবং যেমনিব আমাদের প্রতি অশ্রদ্ধা করে তাহার পৌরুষক্ষয়কর অপমানজনক আদেশও প্রফুল্লমুখে পালন করিতেছি— এই চাকরি আরো বিস্তার করিতে হইবে ? দেশের শিক্ষিত-সম্প্রদায়ের বন্ধনকে আরো দৃঢ় করিতে হইবে ? আমরা যদি স্বদেশের কর্মভার নিজে গ্রহণ করিতাম তবে গবর্মেন্টের আপিস রাক্ষসের মতো আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকদিগকে কি এমন নিঃশেষে গ্রাস করিত । আবেদনের দ্বারা সরকারের চাকরি নহে, পৌরুষের দ্বারা স্বদেশের কর্মক্ষেত্র বিস্তার করিতে হইবে । যাহাতে আমাদের ডাক্তার, আমাদের শিক্ষক, আমাদের এঞ্জিনিয়ারগণ দেশের অধীন থাকিয়া দেশের কাজেই আপনার যোগ্যতার ক্ষতিসাধন করিতে পারেন, আমাদিগকে তাহার ব্যবস্থা করিতেই হইবে । নতুবা আমাদের যে কী শক্তি আছে, তাহার পরিচয়ই আমরা পাইব না। তা ছাড়া, এ-কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে যে, সেবার অভ্যাসের দ্বারাই প্রীতির উপচয় হয় ; যদি আমরা শিক্ষিতগণ এমন কোথাও কাজ করিতাম যেখানে ‘দেশের কাজ করিতেছি? এই ধারণা সর্বদা স্পষ্টরূপে জাগ্রত থাকিত, তবে ‘দেশকে ভালোবাসো’ এ-কথা নীতিশাস্ত্রের সাহায্যে উপদেশ দিতে হইত না । তবে একদিকে যোগ্যতার অভিমান করা, অন্যদিকে প্রত্যেক অভাবের জন্য পরের সাহায্যের প্রার্থী হওয়া— এমনতরো অদ্ভূত অশ্রদ্ধাকর আচরণে আমাদিগকে প্রবৃত্ত হইতে হইত না, দেশের শিক্ষা স্বাধীন হইত এবং শিক্ষিত-সমাজের শক্তি বন্ধনমুক্ত হইত। জর্জীয়গণ, আর্মানিগণ প্রবল জাতি নহে— ইহার যে-সকল কাজ প্রতিকুল অবস্থাতেও নিজে করিতেছে, আমরা কি সেই-সকল কাজেরই জন্য দরবার করিতে দৌড়াই না । কৃষিতত্ত্বপারদর্শীদের লইয়া আমরাও কি আমাদের দেশের কৃষির উন্নতিতে প্রবৃত্ত হইতে পারিতাম না । আমাদের ডাক্তার লইয়া আমাদের দেশের স্বাস্থ্যবিধানচেষ্টা কি আমাদের পক্ষে অসম্ভব । আমাদের পল্লীর শিক্ষাভার কি আমরা গ্রহণ করিতে পারি না । যাহাতে মামলা-মকদ্দমায় লোকের চরিত্র ও সম্বল নষ্ট না হইয়া সহজ বিচারপ্রণালীতে সালিস-নিষ্পত্তি দেশে চলে, তাহার ব্যবস্থা করা কি আমাদের সাধ্যাতীত । সমস্তই সম্ভব হয়, যদি আমাদের এই-সকল স্বদেশী চেষ্টাকে যথার্থভাবে প্রয়োগ করিবার জন্য একটা দল বাধিতে পারি। এই দল, এই কতৃসভা আমাদিগকে স্থাপন করিতেই হইবে— নতুবা বলিব, আজ আমরা যে একটা উত্তেজনা প্রকাশ করিতেছি, তাহা মাদকতা মাত্র, তাহার অবসানে অবসাদের পঙ্কশয্যায় লুণ্ঠন করিতে হইবে।