পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O88 রবীন্দ্র-রচনাবলী তা ছাড়া কোন লক্ষণের দ্বারা জেনেছিলেন আমি তো তা বলতে পারি নে। বোধ করি অসামান্ত লোকদের ছাত্র-অবস্থায় যত্বণত্ব জ্ঞান থাকে না। কাশীশ্বরী শ্বশুরবাড়িতে ছিল, তাই বিনা বাধায় আমি পণ্ডিতমশায়ের ঘরের লোক হয়ে উঠলুম। কয়েক বৎসর পূর্বে তার স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে— কিন্তু তিনি নাতনিতে পরিবৃত। সবগুলি তার স্বকীয়া নয়, তার মধ্যে দুটি ছিল তার পরলোকগত দাদার। বৃদ্ধ এদের নিয়ে আপনার বাধক্যের অপরাহ্লকে নানা রঙে রঙিন করে তুলেছেন। তার অমরুশতক আৰ্যাসপ্তশতী হংসদূত পদাঙ্কদূতের শ্লোকের ধারা মুড়িগুলির চার দিকে গিরিনীর ফেনোচ্ছল প্রবাহের মতো এই মেয়েগুলিকে ঘিরে ঘিরে সহস্তে ধ্বনিত হয়ে উঠছে। আমি হেসে বললুম, “পণ্ডিতমশায়, ব্যাপারখানা কী!” তিনি বললেন, “বাবা, তোমাদের ইংরাজি শাস্ত্রে বলে যে, শনিগ্রহ চাদের মালা পরে থাকেন— এই আমার সেই চাদের মালা ।” সেই দরিদ্র ঘরের এই দৃশুটি দেখে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, আমি একা। বুঝতে পারলুম, আমি নিজের ভারে নিজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পণ্ডিতমশায় জানেন না যে তার বয়স হয়েছে, কিন্তু আমার যে হয়েছে সে আমি স্পষ্ট জানলুম। বয়স হয়েছে বলতে এইটে বোঝায়, নিজের চারি দিককে ছাড়িয়ে এসেছি— চার পাশে ঢিলে হয়ে ফাক হয়ে গেছে । সে ফাক টাকা দিয়ে, থ্যাতি দিয়ে, বোজানো যায় না। পৃথিবী থেকে রস পাচ্ছি নে, কেবল বস্তু সংগ্রহ করছি, এর ব্যর্থতা অভ্যাসবশত ভুলে থাকা যায়। কিন্তু, পণ্ডিতমশায়ের ঘর যখন দেখলুম তখন বুঝলুম, আমার দিন শুষ্ক, আমার রাত্রিশূন্য। পণ্ডিতমশায় নিশ্চয় ঠিক করে বসে আছেন যে, আমি তার চেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ— এই কথা মনে করে আমার হাসি এল। এই বস্তুজগৎকে ঘিরে একটি অদৃত আনন্দলোক আছে। সেই আনন্দলোকের সঙ্গে আমাদের জীবনের যোগস্থত্র না থাকলে আমরা ত্রিশঙ্কুর মতো শূন্যে থাকি। পণ্ডিতমশায়ের সেই ৰোগ আছে, আমার নেই, এই তফাত । আমি আরামকেদারার দুই হাতায় দুই পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে ভাবতে লাগলুম, পুরুষের জীবনের চার আশ্রমের চার অধিদেবতা। বাল্যে মা ; যৌবনে স্ত্রী ; প্রৌঢ়ে কন্যা, পুত্রবধু বাধক্যে নাতনি, নাতবউ। এমনি করে মেয়েদের মধ্য দিয়ে পুরুষ আপনার পূর্ণতা পায়। এই তত্ত্বটা মর্মরিত শালবনে আমাকে আবিষ্ট করে ধরল। মনের সামনে আমার ভাবী বৃদ্ধবয়সের শেষপ্রাস্ত পর্যন্ত তাকিয়ে দেখলুম— দেখে তার নিরতিশয় নীরসভায় হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল। ঐ মরুপথের মধ্য দিয়ে মুনফার বোঝা ঘাড়ে করে নিয়ে কোথায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মরতে হবে! আর দেরি করলে তো চলবে না। সম্প্রতি চল্লিশ পেরিয়েছি— যৌবনের শেষ থলিটি ঝেড়ে নেবার জন্তে পঞ্চাশ রাস্তার