পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8રર রবীন্দ্র-রচনাবলী তাকে করেছিল বিশেষ কবির মনোগত। ওয়ার্ড স্বার্থের জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডস্বার্থীয়, শেলির ছিল শেলীয়, বাইরনের ছিল বাইরনিক। রচনার ইন্দ্রজালে সেটা পাঠকেরও নিজের হয়ে উঠত। বিশেষ কবির জগতে যেটা আমাদের আনন্দ দিত সেটা বিশেষ ঘরের রসের আতিথ্যে । ফুল তার আপন রঙের গন্ধের বৈশিষ্ট্যদ্বারায় মৌমাছিকে নিমন্ত্রণ পাঠায় ; সেই নিমন্ত্রণলিপি মনোহর। কবির নিমন্ত্রণেও স্বভাবতই সেই মনোহারিত ছিল । যে-যুগে সংসারের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিত্ব-সম্বন্ধটা প্রধান সে-যুগে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণকে সযত্নে জাগিয়ে রাখতে হয় ; লে-যুগে বেশে ভূষায় শোভনরীতিতে নিজের পরিচয়কে উজ্জল করবার একটা যেন প্রতিযোগিতা থাকে। দেখা যাচ্ছে, উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজি কাব্যে পূর্ববর্তীকালের আচারের প্রাধান্ত ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দিকে বাক ফিরিয়েছিল । তখনকার কালে সেইটেই হল আধুনিকতা । কিন্তু, আজকের দিনে সেই আধুনিকতাকে মধাভিক্টোরীয় প্রাচীনতা সংজ্ঞা দিয়ে তাকে পাশের কামরায় আরাম-কেদারায় শুইয়ে রাখবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনকার দিনে ছাট কাপড় ছাটা চুলের খট্‌খটে আধুনিকতা। ক্ষণে ক্ষণে গালে পাউডার, ঠোটে রঙ লাগানো হয় না তা নয় ; কিন্তু সেটা প্রকাশ্বে, উদ্ধত অসংকোচে । বলতে চায় মোহ জিনিসটাতে আর-কোনো দরকার নেই। স্থষ্টিকর্তার স্বষ্টিতে পদে পদে মোহ ; সেই মোহের বৈচিত্র্যই নানা রূপের মধ্য দিয়ে নানা স্বর বাজিয়ে তোলে । কিন্তু, বিজ্ঞান তার নাড়ীনক্ষত্র বিচার ক’রে দেখেছে ; বলছে, মূলে মোহ নেই, আছে কার্বন, আছে নাইট্রোজেন, আছে ফিজিয়লজি, আছে সাইকলজি। আমরা সেকালের কবি, আমরা এইগুলোকেই গৌণ জানতুম, মায়াকেই জানতুম মুখ্য। তাই স্থষ্টিকর্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছন্দে বন্ধে ভাষায় ভঙ্গিতে মায়া বিস্তার ক’রে মোহ জন্মাবার চেষ্টা করেছি, এ কথা কবুল করতেই হবে। ইশারা-ইঙ্গিতে কিছু লুকোচুরি ছিল ; লজ্জার ৰেআবরণ সত্যের বিরুদ্ধ নয়, সত্যের আভরণ, সেটাকে ত্যাগ করতে পারি নি। তার ঈষৎ বাম্পের ভিতর দিয়ে যে রঙিন আলো এসেছে সেই আলোতে উষা ও সন্ধ্যার একটি রূপ দেখেছি, নববধূর মতো তা সকরুণ। আধুনিক দুঃশাসন জনসভায় বিশ্বদ্রৌপদীর বস্ত্রছরণ করতে লেগেছে ; ও দৃপ্তটা আমাদের অভ্যস্ত নয়। সেই অভ্যাসপীড়ার জন্তেই কি সংকোচ লাগে। এই সংকোচের মধ্যে কোনো সত্য কি নেই। স্বষ্টিতে যে-আবরণ প্রকাশ করে, আচ্ছন্ন করে না, তাকে ত্যাগ করলে সৌন্দর্ধকে কি নিঃস্ব হতে হয় না। কিন্তু, আধুনিক কালের মনের মধ্যেও তাড়াহুড়ে, সময়েরও অভাব। জীবিকা জিনিসটা জীবনের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। তাড়া-লাগানে যন্ত্রের ভিড়ের মধ্যেই