পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৫২ রবীন্দ্র-রচনাবলী জাতিদিগকে জাগ্ৰত করিয়া দিল এবং ব্রহ্মদেশ হইতে আরম্ভ করিয়া অতিদূর জাপান পর্যন্ত ভিন্নভাষী অনাত্মীয়দিগকে ধৰ্মসম্বন্ধে ভারতবর্ষের সঙ্গে একাত্মা করিয়া দিয়াছে, ভারতক্ষেত্রে সেই মহৎ শক্তির অভু্যদয় কি কেবল ভারতের ভাগেই পরিণামহীন পণ্ডতাতেই পর্যবসিত হইয়াছে ? তাহার পরে এশিয়ার পশ্চিমতম প্রান্তে দৈববলের প্রেরণায় মানবের আর-এক মহাশক্তি মুপ্তি হইতে জাগ্রত হইয় ঐক্যমন্ত্র বহন করিয়া দারুণবেগে পৃথিবী প্লাবিত করিতে বাহির হইল ; সেই শক্তিস্রোতকে বিধাতা যে কেবল ভারতবর্ষে আহবান করিয়াছেন তাহা নহে, এইখানেই তিনি তাহাকে চিরদিনের জন্ত আশ্রয় দিয়াছেন। আমাদের ইতিহাসে এই ব্যাপার কি কোনো একটা আকস্মিক উৎপাত মাত্র ? ইহার মধ্যে নিতাসত্যের কোনো চিরপরিচয় নাই ? তাহার পরে যুরোপের মহাক্ষেত্রে মানবশক্তি প্রাণের প্রাবলো, বিজ্ঞানের কৌতুহলে, পণ্যসংগ্রহের আকাঙ্কায় যখন বিশ্বাভিমুখী হইয়া বাহির হইল তখন তাহারও একটি বৃহৎ প্রবল ধারা এই ভারতবর্ষে আসিয়াই বিধাতার আহবান বহন করিয়া আমাদিগকে আঘাতের দ্বারা জাগ্ৰত করিয়া তুলিতেছে। এই ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের প্লাবন অপসারিত হইয়া গেলে পর যখন খণ্ড খণ্ড দেশের পণ্ড খণ্ড ধর্মসম্প্রদায় বিরোধবিচ্ছিন্নতায় চতুর্দিককে কণ্টকিত করিয়া তুলিয়াছিল তখন শংকরাচার্য সেই সমস্ত খণ্ডতা ও ক্ষুদ্রতাকে একমাত্র অপও বৃহত্ত্বের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করিবার চেষ্টায় ভারতবর্ষের প্রতিভারই পরিচয় দিয়াছিলেন । অবশেষে দার্শনিক জ্ঞানপ্রধান সাধন যখন ভারতবর্ষে জ্ঞানী-অজ্ঞানী অধিকারী-অনধিকারীকে বিচ্ছিন্ন করিতে লাগিল, তখন চৈতন্য, নানক, দাদু, কবীর ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে জাতির অনৈক্য শাস্ত্রের অনৈক্যকে ভক্তির পরম ঐক্যে এক করিবার অমৃত বর্ষণ করিয়াছিলেন । কেবলমাত্র ভারতবর্ষের প্রাদেশিক ধর্মগুলির বিচ্ছেদক্ষত প্রেমের দ্বারা মিলাইয়া দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহা নহে—র্তাহারাই ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান প্রকৃতির মাঝখানে ধর্মসেতু নির্মাণ করিতেছিলেন । ভারতবর্ষ এখনই যে নিশ্চেষ্ট হইয়া আছে তাহা নহে—রামমোহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ, কেশবচন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দ, শিবনারায়ণ স্বামী ইহারাও অনৈক্যের মধ্যে এককে, ক্ষুদ্রতার মধ্যে ভূমাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য জীবনের সাধনাকে ভারতবর্ষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন । অতীতকাল হইতে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের এই এক-একটি অধ্যায় ইতিহাসের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত প্ৰলাপমাত্র নহে,—ইহারা পরস্পর গ্রথিত, ইহার কেহই একেবারে স্বপ্নের মতে অন্তর্ধান করে নাই,—ইহারা সকলেই রহিয়াছে ; ইহার সন্ধিতেই হউক সংগ্রামেই হউক ঘাতপ্রতিঘাতে বিধাতার অভিপ্রায়কে অপূর্ব বিচিত্ররূপে সংরচিত করিয়া