পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী সেই অনিবার্য অনিশ্চয়তার প্রতি দোষারোপ করিয়া যিনি পুরা নকলের দিকে যান, তিনি অত্যস্ত কুদৃষ্টাস্ত দেখান। * কারণ, আলস্য সংক্রমিক। পরের তৈরি জিনিসের লোভে নিজের সমস্ত চেষ্টা বিসর্জন দিবার নজির পাইলে, লোকে তাহাতে আকৃষ্ট হয়। ভুলিয়া যায়, পরের জিনিস কখনই আপনার করা যায় না। ভুলিয়া যায়, পরের কাপড় পরিতে হইলে, চিরকালই পরের দিকে তাকাইয়া থাকিতে হইবে । জড়ত্ব যাহার আরম্ভ, বিকার তাহার পরিণাম । আজ যদি বলি, কে অত ভাবে, তার চেয়ে বিলিতি দোকানে গিয়া একমুট অর্ডার দিয়া আসি— তবে কাল বলিব, প্যাণ্টলুনটা খাটো হইয়া গেছে, কে এত হাঙ্গাম করে, ইহাতেই কাজ চলিয়া যাইবে। কাজ চলিয়া যায়। কারণ, বাঙালি-সমাজে বিলাতি কাপড়ের অসংগতির দিকে কেহ দৃষ্টিপাত করে না। সেইজন্য বিলাতফেরতদের মধ্যেও বিলাতি সাজ সম্বন্ধে ঢ়িলাভাব দেখা যায় ; সস্তার চেষ্টায় বা আলস্যের গতিকে তাহারা অনেকে এমন ভাবে বেশবিন্যাস করেন, যাহা বিধিমতে অভদ্র । কেবল তাহাই নহে। বাঙালি বন্ধুবু বাড়িতে বিবাহ প্রভৃতি শুভকর্মে বাঙালিভদ্রলোক সাজিয়া আসিতে র্তাহারা অবজ্ঞা করেন, আবার বিলাতি ভদ্রতার নিয়মে নিমন্ত্রণ সাজ পরিয়া আসিতেও আলস্য করেন। পরসজ্জা সম্বন্ধে কোনটা বিহিত, কোনটা অবিহিত, সেটা আমাদের মধ্যে প্রচলিত নাই বলিয়া তাহারা শিষ্টসমাজের বিধিবিধানের অতীত হইয়া যাইতেছেন। ইংরেজি সমাজে তাহারা সামাজিকভাবে চলিতে ফিরিতে পান না । দেশী সমাজকে র্তাহারা সামাজিকভাবে উপেক্ষা করিয়া থাকেন— সুতরাং তাহীদের সমস্ত বিধান নিজের বিধান, সুবিধার বিধান ; সে বিধানে আলস্য-ঔদাসীন্যকে বাধা দিবার কিছুই নাই। বিলাতের এই-সকল ছাড়া-কাপড় ইহাদের পরপুরুষের গাত্রে কিরূপ বীভৎস হইয়া উঠিবে, তাহা কল্পনা করিলে লোমহর্ষণ উপস্থিত হয় । কেবল সাজসজ্জা নহে, আচারব্যবহারে এ-সকল কথা আরও অধিক খাটে । বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেশী প্রথা হইতে র্যাহারা নিজেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করিয়াছেন, তাহদের আচারব্যবহারকে সদাচার-সদব্যবহারের সীমামধ্যে আবদ্ধ করিয়। রাখিবে কিসে। যে-ইংরেজের আচার তাহারা অবলম্বন করিয়াছেন তাহদের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রাখিতে পারেন না, দেশী সমাজের ঘনিষ্ঠত। তাহারা বলপূর্বক ছেদন করিয়াছেন। এঞ্জিন কাটিয়া লইলেও গাড়ি খানিকক্ষণ চলিতে পারে, বেগ একেবারে বন্ধ হয়