পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 9 ) উকিলে উকিলে ছেড়াছিড়ি করিয়া সকল কথাই বাহির করিবে, কেবল সকলের চেয়ে বড়ো কলঙ্কের কথাটা আদালতে প্ৰকাশ হইবার সম্ভাবনা নাই-কারণ, স্বয়ং ধর্ম ছাড়া তার আর-কোনো ফরিয়াদি অবশিষ্ট নাই । এইজন্য সেইটো প্ৰকাশ করিয়া দিব বলিয়াই আজ কলম ধরিলাম । আমার পিতামহ উদ্ধব দত্ত র্তার প্রভুবংশকে বিপদের দিনে নিজের সম্পত্তি দিয়া রক্ষা করিয়াছেন । সেই হইতে আমাদের দারিদ্র্যই অন্য লোকের ধানের চেয়ে মাথা উচু করিয়াছে। আমার পিতা সনাতন দত্ত ডিরোজিয়ের ছাত্র । মদের সম্বন্ধে তীর যেমন অদ্ভুদ নেশা ছিল সত্যের সম্বন্ধে ততোধিক । মা আমাদের একদিন নাপিত ভায়ার গল্প বলিয়াছিলেন শুনিয়া পরদিন হইতে সন্ধ্যার পর আমাদের বাডির ভিতরে যাওয়া তিনি একেবারে বন্ধ করিয়া দিলেন । বাহিরে পড়িবার ঘরে শুইতাম । সেখানে দেয়াল জুড়িয়া ম্যাপগুলা সত্য কথা বলিত, তেপান্তর মাঠের খবর দিত না, এবং সাত সমুদ্র তেরো নদীর গল্পটাকে ফাঁসি কাঠে ঝুলাইয়া রাখিত । সততা সম্বন্ধেও তার শুচিবায়ু প্ৰবল ছিল । আমাদের জবাবদিহির অন্ত ছিল না । একদিন একজন ‘হকার’ দাদাকে কিছু জিনিস বেচিয়াছিল । তারই কোনো একটা মোড়কের একখানা দড়ি লইয়া খেলা করিতেছিলাম। বাবার হুকুমে সেই দড়ি হকারকে ফিরাইয়া দিবার জন্য রাস্তায় আমাকে ছুটিতে হইয়াছিল । আমরা সাধুতার জেলখানায় সততার লোহার বেড়ি পরিয়া মানুষ । মানুষ বলিলে একটু বেশি বলা হয়- আমরা ছাড়া আর সকলেই মানুষ, কেবল আমরা মানুষের দৃষ্টান্তস্থল। আমাদের খেলা ছিল কঠিন, ঠাট্টা বন্ধ, গল্প নীরস, বাক্য স্বল্প, হাসি সংযত, ব্যবহার নিখুঁত । ইহাতে বাল্যলীলার মস্ত যে একটা ফাক পড়িয়ছিল লোকের প্রশংসায় সেটা ভর্তি হইত। আমাদের মাস্টার হইতে মুদি পর্যন্ত সকলেই স্বীকার করিত, দত্তবাড়ির ছেলেরা সত্যযুগ হইতে হঠাৎ পথ ভুলিয়া আসিয়াছে। পাথর দিয়া নিরেট করিয়া বঁধানো রাস্তাতেও একটু ফাক পাইলেই প্ৰকৃতি তার মধ্য হইতে আপনার প্রাণশক্তির সবুজ জয়পতাকা তুলিয়া বসে। আমার নবীন জীবনে সকল তিথিই একাদশী হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু উহারই মধ্যে উপবাসের একটা কোন ফাকে আমি একটুখানি সুধার স্বাদ পাইয়াছিলাম । যে কয়জনের ঘরে আমাদের যাওয়া-আসার বাধা ছিল না তার মধ্যে একজন ছিলেন অখিলবাবু । তিনি ব্ৰাহ্মসমাজের লোক ; বাবা তাকে বিশ্বাস করিতেন। তার মেয়ে ছিল অনসূয়া, আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোটো । আমি তার শাসনকর্তার পদ লইয়াছিলাম । তার শিশুমুখের সেই ঘন কালো চোখের পল্লব আমার মনে পড়ে । সেই পল্লবের ছায়াতে এই পৃথিবীর আলোর সমস্ত প্রখরতা তার চোখে যেন কোমল হইয়া আসিয়াছিল। কী স্নিগ্ধ করিয়াই সে মুখের দিকে চাহিত । পিঠের উপরে দুলিতেছে তার সেই বেণীটি, সেও আমার মনে পড়ে ; আর মনে পড়ে সেই দুইখানি হাত- কেন জানি না, তার মধ্যে বড়ো একটি করুণা ছিল । সে যেন পথে চলিতে আর-কারও হাত ধরিতে চায় ; তাই সেই কচি আঙুলগুলি যেন সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিয়া কার মুঠার মধ্যে ধরা দিবার জন্য পথ চাহিয়া আছে । ঠিক সেদিন এমন করিয়া তাকে দেখিতে পাইয়াছিলাম, এ কথা বলিলে বেশি বলা হইবে। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ বুঝিবার আগেও অনেকটা বুঝি। অগোচরে মনের মধ্যে অনেক ছবি আঁকা হইয়া যায়হঠাৎ একদিন কোনো-এক দিক হইতে আলো পড়িলে সেগুলা চোখে পড়ে । অনুর মনের দরজায় কড়া পাহারা ছিল না । সে যা-তা বিশ্বাস করিত। একে তো সে তার বুড়ি দাসীর কাছ হইতে বিশ্বতত্ত্ব সম্বন্ধে যে-সমস্ত শিক্ষা লাভ করিয়াছিল তা আমার সেই ম্যাপ-টাঙানো পড়িবার ঘরের জ্ঞানভাণ্ডারের আবর্জনার মধ্যেও ঠাই পাইবার যোগ্য নয় ; তার পরে সে আবার নিজের কল্পনার যোগেও কত কী যে সৃষ্টি করিত তার ঠিকানা নাই। এইখানে কেবলই তাকে আমার শাসন করিতে হইত। কেবলই বলিতে হইত, “অনু, এ-সমস্ত মিথ্যা কথা, তা জান ! ইহাতে পাপ হয় !” শুনিয়া অনুর দুই চােখে কালো পল্লবের ছায়ার উপরে আবার একটা ভয়ের ছায়া পড়িত। অনু