ናisIQ8ጂ ○br● তার সব হিসাব । এই সঙ্গে গায়ালাবাড়ির এবং মুন্দির দোকানের দেনার হিসােবও টােকা আছে, কেবল তার নিজের ঠিকানা নেই। এইটুকু বুঝতে পারলুম, অনিল চলে গেছে। সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে দেখলুম- আমার শ্বশুরবাড়িতে খোজ নিলুম- কোথাও সে নেই। কোনো একটা বিশেষ ঘটনা ঘটলে সে সম্বন্ধে কিরকম বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়, কোনোদিন আমি তার কিছুই ভেবে পাই নে । বুকের ভিতরটা হা-হা করতে লাগল। হঠাৎ পয়লা-নম্বরের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ । দেউড়ির কাছে দরোয়ানজি গড়গড়ায় তামাক টানছে । রাজাবাবু ভোররাত্রে চলে গেছেন । মনটার মধ্যে ছ্যাক করে উঠল। হঠাৎ বুঝতে পারলুম, আমি যখন একমনে নব্যতম ন্যায়ের আলোচনা করছিলুম। তখন মানবসমাজের পুরাতনতম একটি অন্যায় আমার ঘরে জাল বিস্তার করছিল। ফ্লোবেয়ার, টলস্টয়, টুৰ্গেনিভ, প্রভৃতি বড়ো ঘাড়ো গল্পলিখিয়েদের বইয়ে যখন এইরকমের ঘটনার কথা পড়েছি তখন বড়ো আনন্দে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম করে তার তত্ত্বকথা বিশ্লেষণ করে দেখেছি। কিন্তু, নিজের ঘরেই যে এটা এমন সুনিশ্চিত করে ঘটতে পারে, তা কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করি নি। প্রথম ধাক্কাটাকে সামলে নিয়ে আমি প্ৰবীণ তত্ত্বজ্ঞানীর মতো সমস্ত ব্যাপারটাকে যথোচিত হালকা করে দেখবার চেষ্টা করলুম। যেদিন আমার বিবাহ হয়েছিল সেইদিনকার কথাটা মনে করে শুষ্ক হাসি হাসলুম। মনে করলুম, মানুষ কত আকাঙক্ষা, কত আয়োজন, কত আবেগের অপব্যয় করে থাকে । কত দিন, কত রাত্রি, কত বৎসর নিশ্চিন্ত মনে কেটে গেল ; স্ত্রী বলে একটা সজীব পদার্থ নিশ্চয় আছে ব’লে চোখ বুজে ছিলুম ; এমন সময় আজ হঠাৎ চোখ খুলে দেখি, বুদবুদ ফেটে গিয়েছে। গেছে যাক গে।— কিন্তু জগতে সবই তো বুদবুদ নয়। যুগযুগান্তরের জন্মমৃত্যুকে অতিক্রম করে টিকে রয়েছে এমন—সব জিনিসকে আমি কি চিনতে শিখি নি । কিন্তু দেখলুম, হঠাৎ এই আঘাতে আমার মধ্যে নব্যাকালের জ্ঞানীটা মুছিত হয়ে পড়ল, আর কোন আদিকালের প্রাণীটা জেগে উঠে ক্ষুধায় কেঁদে বেড়াতে লাগল। বারান্দায় ছাতে পায়চারি করতে চুপ করে বসে থাকতে দেখেছি, একদিন আমার সেই শোবার ঘরে গিয়ে পাগলের মতো সমস্ত জিনিসপত্র ঘাটতে লাগলুম। অনিলের চুল বঁধবার আয়নার দেরাজটা হঠাৎ টেনে খুলতেই রেশমের লাল ফিতেয় বাধা একতাড়া চিঠি বেরিয়ে পড়ল। চিঠিগুলি পয়লা-নম্বর থেকে এসেছে। বুকটা জ্বলে উঠল । একবার মনে হল, সবগুলো পুড়িয়ে ফেলি। কিন্তু, যেখানে বড়ো বেদনা সেইখানেই ভয়ংকর টান । এ চিঠিগুলো সমস্ত না পড়ে আমার থাকবার জো নেই। এই চিঠিগুলি পঞ্চাশবার পড়েছি। প্রথম চিঠিখানা তিন-চার টুকরো করে ছেড়া। মনে হল, পাঠিক পড়েই সেটি ছিড়ে ফেলে তার পরে আবার যত্ন করে একখানা কাগজের উপরে গদ দিয়ে জুড়ে রেখেছে। সে চিঠিখানা এই-- “আমার এ চিঠি না পড়েই যদি তুমি ছিড়ে ফেলো। তবু আমার দুঃখ নেই। আমার যা বলবার কথা তা আমাকে বলতেই হবে । “আমি তোমাকে দেখেছি। এতদিন এই পৃথিবীতে চোখ মেলে বেড়াচ্ছি, কিন্তু দেখবার মতো দেখা আমার জীবনে এই বত্রিশ বছর বয়সে প্রথম ঘটল । চোখের উপরে ঘুমের পর্দা টানা ছিল ; তুমি সোনার কাঠি ছুইয়ে দিয়েছ- আজ আমি নবজাগরণের ভিতর দিয়ে তোমাকে দেখলুম, যে-তুমি স্বয়ং তোমার সৃষ্টিকর্তার পরম বিস্ময়ের ধন সেই অনির্বাচনীয় তোমাকে । আমার যা পাবার তা পেয়েছি, আর কিছু চাই নে, কেবল তোমার স্তব তোমাকে শোনাতে চাই। যদি আমি কবি হতুম তা হলে আমার এই স্তব চিঠিতে তোমাকে লেখবার দরকার হত না, ছন্দের ভিতর দিয়ে সমস্ত জগতের কণ্ঠে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে যৌতুম। আমার এ চিঠির কোনো উত্তর দেবে না, জানি- কিন্তু, আমাকে ভুল বুঝো না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারি, এমন সন্দেহমাত্ৰ মনে না রেখে আমার পূজা নীরবে: গ্ৰহণ কোরো । আমার এই শ্রদ্ধাকে যদি তুমি শ্ৰদ্ধা করতে পার তাতে তোমারও ভালো হবে । আমি