পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সভাপতির অভিভাষণ সাহিত্যসাধনার ভিন্ন ভিন্ন মাগ আছে। একটি হচ্ছে কর্মকাণ্ড । সভাসমিতির সভাপতিত্ব করে দরবার জমানো, গ্রন্থাবলী সম্পাদন করা, সংবাদপত্র পরিচালনা করা, এগুলি হল কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত । এই মাগের র্যারা পথিক তারা জানেন কেমন করে স্বচ্ছন্দে সাহিত্যসংসারের কাজ চালাতে হয় । তার পরের মার্গ হচ্ছে জ্ঞানকাণ্ড, যেমন ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, দর্শন প্রভৃতির আলোচনা । এর দ্বারাও সাহিত্যিক সভা জমিয়ে তুলে কীৰ্তিখ্যাতি হাততালি লাভ করা যায়। আমি শিশুকাল থেকেই এই উভয় মার্গ থেকে ভ্ৰষ্ট । এখন বাকি রইল আর-এক মাগ, সেটি হচ্ছে রসমাগা । এই মার্গ অবলম্বন করে রসসাহিত্যের আলোচনা, আমি পারি বা না পারি, করে যে এসেছি সে কথা আর গোপন রইল না । বহুকাল পূর্বে নির্জনে বিরলপথে এই রসাভিসারে বার হয়েছিলুম, দূরে বংশীধ্বনি শুনতে পেয়ে । কিন্তু, এই অভিসারপথ যে নিকটের লোকনিন্দা ও লাঞ্ছনার দ্বারা দুৰ্গম, তা র্যারা রাসচর্চা করেছেন তারাই জানেন । ঘরের সীমা হতে, প্রয়োজনের শাসন থেকে, অনেক দূরে বের করে নিয়ে যায় যে-তান। সেই তান কানে এসে পৌঁচেছিল, তাই নিকটের বাধা সত্ত্বেও বাহির হতে হয়েছিল। তাই আজ এত বয়স পর্যন্ত বংশীধ্বনি ও গঞ্জনা দুই-ই শুনে এসেছি । যে-পথে চলেছিলাম তা হাট-ঘাটের পথ নয় । তাই আমি নিয়মের রাজ্যের ব্যবস্থা ভালো বুঝি নে । রসমার্গের পথিককে পদে পদে নিয়ম লঙ্ঘন করে চলতে হয়, সেই কু-অভ্যাসটি আমার অস্থিমজ্জাগত। তাই নিয়মের ক্ষেত্রে আমাকে টেনে আনলে আমি কর্মের সৌষ্ঠব রক্ষা করতে পারি। নে । তবে কেন সভাপতির পদ গ্ৰহণ করতে রাজি হওয়া । এর প্রথম কারণ হচ্ছে যে, “যিনি আমাকে এই পদে আহবান করেন। তিনি আমার সম্মানাহঁ, তার নিমন্ত্ৰণ আমি প্ৰত্যাখ্যান করতে পারি নি । দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে যে, বাংলার বাইরে বাঙালির আহবান যখন আমার কাছে পৌছল, তখন আমি সে আমন্ত্রণ নাড়ীর টানে অস্বীকার করতে পারি নি । এই ডাক শুনে আমার মন কী বলেছিল, আজকার অভিভাষণে সেই কথাটাই সবিস্তারে জানাব । আজ যেমন বসন্ত-উৎসবের দিনে দক্ষিণসমীরণের অভ্যর্থনায় বিশ্বপ্রকৃতি পুলকিত হয়ে উঠেছে, ধরণীর বক্ষে নবকিশলয়ের উৎস উৎসারিত হয়েছে, আজকার সাহিত্য-সম্মিলনের উৎসবে তেমনি একটি বসন্তেরই ডাক আছে । এ ডাক আজকের ডাক নয় । কত কাল হল একদা একটি প্ৰাণসমীরণের হিল্লোল বঙ্গদেশের চিত্তের উপর দিয়ে বয়ে গেল, আর দেখতে দেখতে সাহিত্যের মুদ্রিত দলগুলি বাধাবন্ধ বিদীর্ণ করে বিকশিত হয়ে উঠল । বাধাও ছিল বিস্তর । ইংরাজিসাহিত্যের রাসমত্তিতায় নূতন মাতাল ইংরাজি-শিক্ষিত ছাত্রেরা সেদিন বঙ্গভাষাকে অবজ্ঞা করেছিল । আবার সংস্কৃতসাহিত্যের ঐশ্বর্যগর্বে গর্বিত সংস্কৃত পণ্ডিতেরাও মাতৃভাষাকে অবহেলা করতে ত্রুটি করেন নি । কিন্তু, বহুকালের উপেক্ষিত ভিখারি মেয়ে যেমন বাহিরের সমস্ত অকিঞ্চনত সত্ত্বেও হঠাৎ একদিন নিজের অন্তর হতে উন্মেষিত যৌবনের পরিপূর্ণতায় অপরূপ গৌরবে বিশ্বের সৌন্দর্যলোকে আপন আসন অধিকার করে, অনাদৃত বাংলাভাষা তেমনি করে একদিন সহসা কোন ভাবাবেগের ঔৎসুক্যে আপনি বহুদিনের দীনতার কৃলি ছাপিয়ে দিয়ে মহিমান্বিত হয়ে উঠল । তার সেদিনকার সেই দৈন্যবিজয়ী ভাবযৌবনের স্বরূপটিকেই আজকার নিমন্ত্রণপত্র আমার স্মৃতিমন্দিরে বহন করে এনেছে । মানুষের পরিচয় তখনই সম্পূর্ণ হয় যখন সে যথার্থভাবে আপনাকে প্ৰকাশ করতে পারে । কিন্তু, প্রকাশ তো একান্ত নিজের মধ্যে হতে পারে না । প্ৰকাশ হচ্ছে নিজের সঙ্গে অন্য-সকলের সত্য ১ প্রমথনাথ তর্কভূষণ, সম্মিলনের অভ্যর্থনাসমিতির সভাপতি