পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሱ Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী আনন্দরূপমমৃতং যদবিভতি । আনন্দরূপের অমৃতবাণী বিশ্বে প্রকাশ পাচ্ছে, জলে স্থলে, ফুলে ফলে, বর্ণে গন্ধে, রূপে সংগীতে নৃত্যে, জ্ঞানে ভাবে কর্মে। কবির কাব্যেও সেই বাণীরই ধারা । যে চিত্তযন্ত্রের ভিতর দিয়ে সেই বাণী ধ্বনিত, তার প্রকৃতি-অনুসারে এই প্রকাশ আপনি বিশেষত্ব লাভ করে । এই বিশেষত্বই অসীমকে বিচিত্র সীমা দেয় । এই সীমার সাহায্যেই সীমার অতীতকে আপনি ক’রে নিয়ে তার রস পাই । এই আপনি ক’রে নেওয়াটি ব্যক্তিভেদে কিছু-না-কিছু ভিন্নতা পায় । তাই একই কাব্য কত লোকে আপন মনে কত রকম ক'রে বুঝেছে। সেই বোঝার সম্পূর্ণতা কোথাও বেশি, কোথাও কম, কোথাও অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ, কোথাও অশুদ্ধ। প্রকাশের উৎকর্ষেও যেমন তারতম্য, উপলব্ধির স্পষ্টতাতেও তেমনি । এইজন্যেই কাব্য বোঝবার আনন্দেরও সাধনা করতে হয় । এই বোঝবার কাজে কেউ কেউ কবির সাহায্য চেয়ে থাকেন । তারা ভুলে যান যে, যে-কবি কাব্য লেখেন তিনি এক মানুষ, আর যিনি ব্যাখ্যা করেন তিনি আর-এক জন । এই ব্যাখ্যাকর্তা পাঠকদেরই সমশ্রেণীয়। তার মুখে ভুল ব্যাখ্যা অসম্ভব নয়। আমার কাব্য ঠিক কী কথাটি বলছে, সেটি শোনবার জন্যে, আমাকে বাইরে যেতে হবে- যারা শুনতে পেয়েছেন তাদের কাছে। সম্পূৰ্ণ ক’রে শোনবার ক্ষমতা সকলের নেই। যেমন অনেক মানুষ আছে যাদের গানের কান থাকে না- তাদের কানে সুরগুলো পৌঁছয়, গান পৌঁছয় না, অর্থাৎ সুরগুলির অবিচ্ছিন্ন ঐক্যটি তারা স্বভাবত ধরতে পারে না। কাব্য সম্বন্ধে সেই ঐক্যবোধের অভাব অনেকেরই আছে। তারা যে একেবারেই কিছু পায় না তা নয়- সন্দেশের মধ্যে তারা খাদ্যকে পায়, সন্দেশকেই পায় না । সন্দেশ চিনি-ছানার চেয়ে অনেক বেশি, তার মধ্যে স্বাদের যে-সমগ্ৰতা আছে সেটি পাবার জন্যে রসবোধের শক্তি থাকা চাই । বহু ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার দ্বারা, চর্চার দ্বারা, এই সমগ্রতার অনির্বাচনীয় রসবোধের শক্তি পরিণতি লাভ করে । যে-ব্যক্তি সেরা যাচনদার এক দিকে তার স্বাভাবিক সূক্ষ্ম অনুভূতি, আর-এক দিকে ব্যাপক অভিজ্ঞতা, দুয়েরই প্রয়োজন । এই কারণেই এই-যে পরিষদের প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার সার্থকতা আছে । এখানে কয়েকজন যে একত্র হয়েছেন তার একটিমাত্র কারণ, কাব্য থেকে তারা কিছু-না-কিছু শুনতে পেয়েছেন, তারা উদাসীন নন । এই পরম্পরের শোনা নানা দিক থেকে মিলিয়ে নেবার আনন্দ আছে । আর, র্যারা স্বভাবশ্রোতা, যারা সম্পূর্ণকে সহজে উপলব্ধি করেন, তারা এই পরিষদে আপন যোগ্য আসনটি লাভ করতে পারবেন । এই পরিষদটি যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এতে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি । কবির পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো সুযোগ, পাঠকের শ্রদ্ধা । যুক্তিসিদ্ধ বিষয়ের প্রধান সহায় প্রমাণ, রসসৃষ্টি-পদার্থের প্রধান সহায় শ্রদ্ধা । সুন্দরকে দেখবার পক্ষে অশ্রদ্ধার মতো অন্ধতা আর নেই। এই বিশ্বরচনায় সুন্দরের ধৈর্য অপরিসীম । চিত্তে যখন উপেক্ষা, শ্রদ্ধা যখন অসাড়, তখনো প্ৰভাতে সন্ধ্যায় ঋতুতে ঋতুতে সুন্দর আসেন, কোনো অৰ্ঘ্য না নিয়ে চলে যান, তাকে যে গ্রহণ করতে না পারলে সে জানতেও পারে না যে সে বঞ্চিত । যুগে যুগে মানুষের সৃষ্টিতেও এমন ঘটনা ঘটেছে, অশ্রদ্ধার অন্ধকার রাত্রে সুন্দর অলক্ষ্যে এসেছেন, দীপ জ্বালা হয় নি, অলক্ষো চলে গিয়েছেন । সাহিত্যে ও কলারচনায় আজ আমাদের যে সঞ্চয় তা যুগ-যুগান্তর বহু অপচয়ের পরিশিষ্ট তাতে সন্দেহ নেই। অনেক অতিথি ফিরে যায় রুদ্ধদ্বারে বৃথা আঘাত ক’রে, কেউ-বা দৈবক্রমে এসে পড়ে যখন গৃহস্থ জেগে আছে । কেউ-বা অনেক দ্বার থেকে ফিরে গিয়ে হঠাৎ দেখে একটা গৃহের দ্বার খোলা । আমার সৌভাগ্য এই যে, এখানে দ্বার খোলা পেয়েছি, আহবান শুনতে পাচ্ছি। ‘এসো' ! এই পরিষদ আমাকে শ্রদ্ধার আসন দেবার জন্যে প্ৰস্তুত ; স্বদেশের আতিথ্য এইখানে অকৃপণ ; এই সভার সভ্যদের কাছে আমার পরিচয় অন্তত ঔদাসীন্যের দ্বারা ক্ষুন্ন হবে না । দেশবিদেশে আমার সম্মানের বিবরণ আমার বন্ধু এইমাত্র বর্ণনা করেছেন । বাইরের দিক থেকে বিদেশের কাছে আমার পরিচয় পরিমাণ-হিসাবে অতি অল্প । আমার লেখার সামান্য এক অংশের তরজমা তাদের কাছে পৌচেছে, সে তরজমারও অনেকখানি যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। কিন্তু সাহিত্যে,