পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gły8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মীেমাছির দল এসে নতুন যুগের মৌচাক বানাতে লেগে যায় । সাহিত্যের যুগ বলতে কী বোঝায় সেটা বোঝাপড়া করবার সময় হয়েছে। কয়লার খনিক বা পানওয়ালীদের কথা অনেকে মিলে লিখলেই কি নবযুগ আসে । এইরকমের কোনো একটা ভঙ্গিমার দ্বারা যুগান্তরকে সৃষ্টি করা যায়, এ কথা মানতে পারব না। সাহিত্যের মতো দলছাড়া জিনিস আর কিছু নেই । বিশেষ একটা চাপরাশ-পরা সাহিত্য দেখলেই গোড়াতেই সেটাকে অবিশ্বাস করা উচিত । কোনো-একটা চাপরাশের জোরে যে-সাহিত্য আপন বিশিষ্টতার গৌরব খুব চড়া গলায় প্রমাণ করতে দাড়ায়, জানিব, তার গোড়ায় একটা দুর্বলতা আছে। তার ভিতরকার দৈন্য আছে বলেই চাপরাশের দেমাক বেশি হয় । যুরোপের কোনো কোনো লেখক শ্রমজীবীদের দুঃখের কথা লিখেছে, কিন্তু সেটা যে-ব্যক্তি লিখেছে সেই লিখেছে। দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন নীলদর্পণ নাটক, দীনবন্ধু মিত্রই তার সৃষ্টিকর্তা । ওর মধ্যে যুগের তকমাটাই সাহিত্যের লক্ষণ বানিয়ে বসে নি। আজকের দিনে বারো-আনা লোক যদি চরকা নিয়েই কাব্য ও গল্প লিখতে বসে তা হলেও যুগসাহিত্যের সৃষ্টি হবে না- কেননা তার পনেরোআনাই হবে অসাহিত্য । খাটি সাহিত্যিক যখন একটা সাহিত্য রচনা করতে বসেন তখন তার নিজের মধ্যে একটা একান্ত তাগিদ আছে বলেই করেন ; সেটা সৃষ্টি করবার তাগিদ, সেটা ভিন্ন লোকের ভিন্নরকম । তার মধ্যে পানওয়ালী বা খনিক আপনিই এসে পড়ল। তো ভালোই । কিন্তু, সেই এসে পড়াটা যেন যুগ ধর্মের একটা কায়দার অন্তর্গত না হয় । কোনো-একটা উদ্ভটরকমের ভাষা বা রচনার ভঙ্গি বা সৃষ্টিছাড়া ভাবের আমদানির দ্বারা যদি এ কথা বলবার চেষ্টা হয় যে, যেহেতু এমনতরো ব্যাপার ইতিপূর্বে কখনো হয় নি। সেইজন্যেই এটাতে সম্পূর্ণ নূতন যুগের সূচনা হল, সেও অসংগত । পাগলামির মতো অপূর্ব আর কিছুই নেই, কিন্তু তাকেও ওরিজিনালিটি বলে গ্রহণ করতে পারি নে। সেটা নূতন কিন্তু কখনো চিরন্তন নয়- যা চিরন্তন নয়। তাকে সাহিত্যের জিনিস বলা যায় না। কোনো ব্যক্তিবিশেষ নিজের সাহিত্যিক, পালাটা সাঙ্গ করে চলে যেতে পারেন ; কিন্তু তিনি যে একটা-কোনো যুগকে চুকিয়ে দিয়ে যান কিংবা আর-একজন যখন তার নিজের ব্যক্তিগত প্ৰতিভাকে প্রকাশ করেন তিনি আর-একটা যুগকে এনে হাজির করে দেন, এটা অদ্ভুত কথা। একজন সাহিত্যিক আর-একজন সাহিত্যিককে লুপ্ত করে দিয়ে যান না, তার একটা পাতার পরে আর-একটা পাতা যুক্ত করে দেন । প্ৰাচীন কালে যখন কাগজ যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না। তখন একজনের লেখা চেচে মেজে তারই উপরে আর-একজন লিখত— তাতে পূৰ্বলেখকের চেয়ে দ্বিতীয় লেখকের অধিকতর যোগ্যতা প্রমাণ হত না, এইমাত্র প্রমাণ হত যে, দ্বিতীয় লেখকটি পরবতী । এক যুগ আর-এক যুগকে লুপ্ত না করে আপনার স্থান পায় না, এইটেই যদি সত্য হয় তবে তাতে কেবল কালেরই পূর্বাপরতা প্রমাণ হয় ; তার চেয়ে বেশি কিছু নয়— হয়তো দেখা যাবে, ভাবীকাল উপরিবতী লেখাটাকে মুছে ফেলে তলবতীটাকেই উদ্ধার করবার চেষ্টা করবে। নূতন কাল উপস্থিতমত খুবই প্রবল— তার তুচ্ছতাও স্পর্ধিত ; সে কিছুতেই মনে করতে পারে না যে, তার মেয়াদ বেশিক্ষণের হয়তো নয়। কোনো-এক ভবিষ্যতে সে যে তার অতীতের চেয়েও জীৰ্ণতর প্রমাণিত হতে পারে, এ কথা বিশ্বাস করা তার পক্ষে কঠিন । এইজন্যেই অতি অনায়াসেই সে দম্ভ করে যে, সেই চরম সত্যের পূর্বতন ধারাকে সে অগ্রাহ্য করে দিয়েছে। এ কথা মনে রাখা দরকার, সাহিত্যের সম্পদ চিরযুগের ভাণ্ডারের সামগ্ৰী- কোনো বিশেষ যুগের ছাড়পত্র দেখিয়ে সে আপনার স্থান পায় না । যদি নিজের সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলি, আশা করি, আপনারা মাপ করবেন। আমার বাল্যকালে আমি দুই-একজন কবিকে জানতুম । তঁদের মতো লিখতে পারব, এই আমার আকাঙক্ষা ছিল। লেখবার চেষ্টাও করেছি, মনে কখনো কখনো নিশ্চয়ই অহংকারও হয়েছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা অতৃপ্তিও ছিল । সাহিত্যের যে-রূপটা অন্যের, আমার আত্মপ্ৰকাশকে কোনোমতে সেই মাপের সঙ্গে মিলিয়ে তোলবার চেষ্টা করে কখনো যথার্থ আনন্দ হতে পারে না । যা হােক, বাল্যকালে যখন নিজের অন্তরে কোনো আদর্শ উপলব্ধি করতে পারিনি, তখন বাইরের আদর্শের অনুবর্তন করে যতটুকু ফল লাভ করা যেত সেইটোকেই সার্থকতা বলে মনে করতুম |