পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালাতন্তর V906 বসিল । তার পর থেকে বছর বছর পঞ্জিকাতে ঘোষণা দেখা গেল, শুক্লপক্ষের কার্তিকসপ্তমীতে যে ব্যক্তি খুঁটীশ্বরীকে এক সেরা ছাগদুগ্ধ ও তিন তোলা রজত দিয়ে পূজা দেয় তার সেই পূজা ত্রিকোটিকুলমূদ্ধরেৎ । এমনি করে অবুদ্ধির রাজত্বে আকস্মিক খুঁটি সমন্তই সনাতন হয়ে ওঠে, লোকচলাচলের রাস্তায় চলার চেয়ে বাধা পড়ে থাকাটা সহজ হয়ে ওঠে । ধারা নিষ্ঠাবান তারা বলেন, আমরা বিধাতার বিশেষ সৃষ্টি, অন্য কোনো জাতের সঙ্গে আমাদের মেলে না, অতএব রাস্তা বন্ধ হলেও আমাদের চলে। কিন্তু খুঁটি না থাকলে আমাদের ধর্ম থাকে না । যারা খুঁটীশ্বরীকে মানেও না, এমন-কি, যারা বিদেশী ভাবুক, তারাও বলে, আহা, একেই তো বলে আধ্যাত্মিকতা- নিজের জীবনযাত্রার সমস্ত সুযোগ-সুবিধাই এরা মাটি করতে রাজি, কিন্তু মাটি থেকে একটা খুঁটি এক ইঞ্চি পরিমাণও ওপড়াতে চায় না । সেইসঙ্গে এও বলে, আমাদের বিশেষত্ব অন্য রকমের, অতএব আমরা এদের অনুকরণ করতে চাই নে, কিন্তু এরা যেন হাজার খুঁটিতে ধর্মের বেড়াজালে এইরকম বাধা হয়ে অত্যন্ত শান্ত সমাহিত হয়ে পড়ে থাকে- কারণ, এটি দূর থেকে দেখতে বড়ো সুন্দর । সৌন্দর্য নিয়ে তর্ক করতে চাই নে । সেটা রুচির কথা । যেমন ধর্মের নিজের অধিকারে ধর্ম বড়ো, তেমনি সুন্দরের নিজের অধিকারে সুন্দর বড়ো । আমার মতো অর্বািচীনেরা বুদ্ধির অধিকারের দিক থেকে প্রশ্ন করবে, এমনতরো খুঁটি-কণ্টকিত পথ দিয়ে কখনো স্বাতন্ত্র্যসিদ্ধির রথ কি এগোতে পারে । বুদ্ধির অভিমানে বুক বেঁধে নব্যতন্ত্রী প্রশ্ন করে বটে, কিন্তু রাত্রে আর ঘুম হয় না। যেহেতু গৃহিণীরা স্বস্ত্যয়নের আয়োজন করে বলেন, “ছেলে-পুলে নিয়ে ঘর, কী জানি কোন খুঁটি কোন দিন বা দৃষ্টি দেয় । তোমরা চুপ করে থাকো-না। কলিকালে খুঁটি নাড়া দেবার মতো ডানপিটে ছেলের তো অভাব নেই।” শুনে আমাদের মতো নিছক আধুনিকদেরও বুক ধুকধুক করতে থাকে, কেননা রক্তের ভিতর থেকে সংস্কারটাকে তো ছেকে ফেলতে পারি। নে । কাজেই পরের দিন ভোরবেলাতেই এক সেরের বেশি ছাগদুগ্ধ, তিন তোলার বেশি রাজত খরচ করে। হাফ ছেড়ে বাচি । এই তো গেল আমাদের সব চেয়ে প্রধান সমস্যা । যে বুদ্ধির রাস্তায় কর্মের রাস্তায় মানুষ পরস্পরে মিলে সমৃদ্ধির পথে চলতে পারে সেইখানে খুঁটি গেড়ে থাকার সমস্যা ; যাদের মধ্যে সর্বদা আনাগোনার পথ সকল রকমে খোলসা রাখতে হবে তাদের মধ্যে অসংখ্য খুঁটির বেড়া তুলে পরস্পরের ভেদকে বহুধা ও স্থায়ী করে তোলার সমস্যা ; বুদ্ধির যোগে যেখানে সকলের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে, অবুদ্ধির অচল বাধায় সেখানে সকলের সঙ্গে চিরবিচ্ছিন্ন হবার সমস্যা ; খুঁটিরূপিণী ভেদবুদ্ধির কাছে ভক্তিভরে বিচার-বিবেককে বলিদান করবার সমস্যা ! ভাবুক লোকে এই সমস্যার সামনে দাড়িয়ে ছলছল নেত্ৰে বলেন, আহা, এখানে ভক্তিটাই হল বড়ো কথা এবং সুন্দর কথা, খুঁটিটা তো উপলক্ষ । আমাদের মতো আধুনিকেরা বলে, এখানে বুদ্ধিটাই হল বড়ো কথা, সুন্দর কথা, খুঁটিটাও জঞ্জাল, ভক্তিটাও জঞ্জাল । কিন্তু আহা, গৃহিণী যখন অশুভ-আশঙ্কায় করজোড়ে গলবস্ত্র হয়ে দেবতার কাছে নিজের ডান হাত বাধা রেখে আসেন তার কী অনির্বচনীয় মাধুর্য ! আধুনিক বলে, যেখানে ডান হাত উৎসর্গ করা সার্থক, যেখানে তাতে নেই। অন্ধতা, যেখানে তাতে আছে সাহস, সেখানেই তার মাধুর্য ; কিন্তু যেখানে অশুভ-আশঙ্কা মূঢ়তা-রূপে দীনতা-রূপে তার কুশ্ৰী কবলে সেই মাধুর্যকে গিলে খাচ্ছে সুন্দর সেখানে পরাস্ত- কল্যাণ সেখানে পর্যাহত । আমাদের আর-একটি প্রধান সমস্যা হিন্দু-মুসলমান সমস্যা । এই সমস্যার সমাধান এত দুঃসাধ্য তার কারণ দুই পক্ষই মুখ্যত আপন আপনি ধর্মের দ্বারাই অচলভাবে আপনাদের সীমানির্দেশ করেছে। সেই ধর্মই তাদের মানবৱিশ্বকে সাদা কালো ছক কেটে দুই সুস্পষ্ট ভাগে বিভক্ত করেছে- আত্ম ও পর। সংসারে সর্বত্রই আত্মপরের মধ্যে কিছু পরিমাণে স্বাভাবিক ভেদ আছে। সেই ভেদের পরিমাণটা অতিমাত্র হলেই তাতে অকল্যাণ হয় । বুশম্যান-জাতীয় লোক পরকে দেখবা মাত্র তাকে নির্বিশেষে বিষবাণ দিয়ে মারে । তার ফল হচ্ছে, পরের সঙ্গে সত্য মিলনে মানুষের যে মনুষ্যত্ব পরিস্ফুট হয় বুশম্যানের তা হতে পারে নি, সে চূড়ান্ত বর্বরতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। এই ভেদের মাত্রা যে জাতির মধ্যে অন্তরের দিক থেকে যতই কমে এসেছে সেই জাতি ততই উচ্চশ্রেণীর মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ