পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর Ved হিন্দুমুসলমান শ্ৰীযুক্ত কালিদাস নাগকে লিখিত শান্তিনিকেতন কল্যাণীয়েষ্ণু, ঘোর বাদল নেমেছে। তাই আমার মনটা মানব-ইতিহাসের শতাব্দী চিহ্নিত বেড়ায় ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে। আকােশরঙ্গভূমিতে জল-বাতাসের মাতনের যুগগুগান্তরবাহিত স্মৃতিস্পন্দন আজ আমার শিরায় শিরায় মেঘমাল্লারের মীড় লাগিয়েছে। আমার কর্তব্য বুদ্ধি কোথায় ভেসে গেল, সম্প্রতি আমি আমার সামনেকার ঐ সারবন্দী শালতাল-মহুয়াছাতিমের দলে ভিড়ে গেছি। প্ৰাণীরাজ্যে ওদের হল বনেদি বংশ, ওরা কোন আদিকালের রৌদ্রবৃষ্টির উত্তরাধিকার পুরোপুরি ভোগ করে চলেছে। ওরা মানুষের মতো আধুনিক নয়, সেইজন্যে। ওরা চিরনবীন। মানবজাতির মধ্যে কেবল কবিরাই সভ্যতার আভিজাত্য কবিদের নিতান্ত মানুষ বলে অবজ্ঞা করে না । এইজন্যেই বর্ষে বর্ষে বর্ষার সময় আমাকে এমন করে উতলা করে দেয়, আমাকে সকল দায়িত্ববন্ধন থেকে বিরাগি করে প্রাণের খেলাঘরে ডাকতে থাকে— আমাদের মর্মের মধ্যে যে ছেলেমানুষ আছে, যে হচ্ছে আমাদের সব চেয়ে প্রাচীন পূর্বজ, সেই আমার কর্মশালাটি দখল করে বসে। সেইজন্যেই বর্ষা পড়ে অবধি আমি হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির সঙ্গে গাছপালার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বসে গেছি, কাজকর্ম ছেড়ে গান তৈরি করছি- সেই সূত্রে মানুষের মধ্যে আমি সব চেয়ে কম মানুষ হয়েছি- আমার মন ঘাসের মতো কঁপিছে, পাতার মতো ঝিলমিল করছে। কালিদাস এই উপলক্ষেই বলেছিলেন ; মেঘলোকে ভবতি সুখিনোেহপ্যন্যবৃত্তিচেতঃ । অন্যথাবৃত্তি হচ্ছে মানববৃত্তির গণ্ডির বাইরের বৃত্তি । এই বৃত্তি আমাদের সেই সুদূর কালে নিয়ে যায় যখন প্ৰাণের খেলা চলছে, মনের মাস্টারি শুরু হয় নি- আজ যেখানে ইস্কুলের মোটা থাম উঠেছে সেখানে যখন ঘাসের ফুলে ফুলে প্রজাপতি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে । যাই হােক, এই সময়টাতে ঘনমেঘে মধ্যাহ্ন ছায়াবৃত্ত, মাঠে মাঠে বাদল-হাওয়া ভেঁপু বাজিয়ে চলেছে, আর ছােটাে ছােটাে চঞ্চল জলধারা ইস্কুলছাড়া ছাত্রীদের অকারণ হাসির মতো চার দিকে খিলখিল করছে। আজ ৭ই আষাঢ় কৃষ্ণা একাদশী তিথি, আজ অম্বুবাচী আরম্ভ হল। নামটা সার্থক হয়েছে, সমস্ত প্রকৃতি আজ জলের ভাষায় মুখর হয়ে উঠল। ঘনমেঘের চন্দ্ৰাতপের ছায়ায় আজ অম্বুবাচীর গীতিকবিতার আসর বসেছে – তৃণসভার গায়েনের দল ঝিল্লিরাও নিমন্ত্রণ পেয়েছে, আর তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে মত্তদাদুরী । এ আসরে আমার আসন পড়ে নি যে তা মনেও কোরো না । মেঘের ডাকের জবাব না দিয়ে চুপ করে যাব, আমি এমন পাত্র নই। মেঘের পর মেঘের মতো আমারও গান চলেছে দিনের পর দিন ; তার কোনো গুরুত্ব নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই, মেঘ যেমন ‘ধূমজ্যোতিঃসলিলমরুতাং সন্নিপাতঃ’ সেও তেমনি নিরর্থক উপাদানে তৈরি । ঠিক যখন আমার জানলার ধারে বসে গুঞ্জনধ্বনিতে গান ধরেছি।-- আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে, আমার ভাবনা যত উতল হল অকারণে ঠিক এমন সময় সমুদ্রপার হতে তোমার প্রশ্ন এল, ভারতবর্ষে হিন্দুমুসলমান-সমস্যার সমাধান কী । হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মানবসংসারে আমার কাজ আছে- শুধু মেঘমাল্লারে মেঘের ডাকের জবাব দিয়ে চলবে না, মানব-ইতিহাসের যে-সমস্ত মেঘমন্দ্র প্রশ্নাবলী আছে তারও উত্তর ভাবতে হবে । তাই অম্বুবাচীর আসর পরিত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে হল। S SR 1 8 O