পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬২৬ | রবীন্দ্র-রচনাবলী সপ্তম পরিচ্ছেদ চন্দ্ৰদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র রায় তাহার রাজকক্ষে বসিয়া আছেন । ঘরটি অষ্টকোণ । কড়ি হইতে কাপড়ে মোড়া ঝাড় ঝুলিতেছে। দেয়ালের কুলঙ্গির মধ্যে একটাতে গণেশের ও বাকিগুলিতে শ্ৰীকৃষ্ণের নানা অবস্থার প্রতিমূর্তি স্থাপিত। সেগুলি বিখ্যাত কারিকর বটকৃষ্ণ কুম্ভকারের স্বহস্তে গঠিত । চারি দিকে চাদর পড়িয়াছে, মধ্যস্থলে জরিখচিত মছলন্দের গদি, তাহার উপর একটি রাজা ও একটা তাকিয়া । তাহার চারি কোণে জরির ঝালর । দেয়ালের চারি দিকে দেশী আয়না ঝুলানো, তাহাতে মুখ ঠিক দেখা যায় না । রাজার চারি দিকে যে-সকল মনুষ্য-আয়না আছে, তাহাতেও তিনি মুখ ঠিক দেখিতে পান না, শরীরের পরিমাণ অত্যন্ত বড়ো দেখায় । রাজার বাম পাৰ্থে এক প্ৰকাণ্ড আলবোলা ও মন্ত্রী হরিশংকর । রাজার দক্ষিণে রামাই ভাড় ও চশমাপরা সেনাপতি ফর্নাণ্ডিজ । রাজা বলিলেন, “ওহে রামাই ।” রামাই বলিল, “আজ্ঞা, মহারাজ ।” রাজা হাসিয়া আকুল । মন্ত্রী রাজার অপেক্ষা অধিক হাসিলেন । ফর্নাণ্ডিজ হাততালি দিয়া হাসিয়া উঠিল । সন্তোষে রমাইয়ের চোখ মিটমিট করিতে লাগিল । রাজা ভাবেন, রমাইয়ের কথায় না হাসিলে অরসিকতা প্ৰকাশ পায় ; মন্ত্রী ভাবেন, রাজা হাসিলে হাসা কর্তব্য ; ফর্নাণ্ডিজ ভাবে, অবশ্য হাসিবার কিছু আছে। তাহা ছাড়া, যে দুৰ্ভাগ্য রামাই ঠোঁট খুলিলে দৈবাৎ না হাসে, রামাই তাহাকে কাদাইয়া ছাড়ে । নহিলে রমাইয়ের মান্ধাতার সমবয়স্ক ঠাট্টাগুলি শুনিয়া অল্প লোকই আমোদে হাসে । তবে ভয়ে ও কর্তব্যজ্ঞানে সকলেরই বিষম হাসি পায়, রাজা হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বারী পর্যন্ত । রামাই ভাবিল রসিকতা করা আবশ্যক । “পরম্পরায় শুনা গেল সেনাপতি মহাশয়ের ঘরে চোরা পড়িয়াছিল।” সেনাপতি মহাশয় অধীর হইয়া উঠিলেন । তিনি বুঝিলেন একটা পুরাতন গল্প তাহার উপর দিয়া চালাইবার চেষ্টা হইতেছে । তিনি রমাইয়ের রসিকতার ভয়ে যেমন কাতর, রামাই প্ৰতিবারে তেমনি তাহাকেই চাপিয়া ধরে । রাজার বড়োই আমোদ । রামাই আসিলেই ফর্নাণ্ডিজকে ডাকিয়া পাঠান । রাজার জীবনে দুইটি প্রধান আমোদ আছে ; এক ভেড়ার লড়াই দেখা, আর রমাইয়ের মুখের সামনে ফর্নাণ্ডিজকে স্থাপন করা ; রাজকার্যে প্রবেশ করিয়া অবধি সেনাপতির গায়ে একটা ছিটাগুলি বা তীরের আঁচড় লাগে নাই। অনবরত হাস্যের গোলাগুলি খাইয়া সে ব্যক্তি কঁাদো কাদো হইয়া আসিয়াছে। পাঠকেরা মার্জনা করিবেন, আমরা রমাইয়ের সকল রসিকতাগুলি লিপিবদ্ধ করিতে পারিব না, সুরুচির অনুরোধে অধিকাংশ স্থলই পরিত্যাগ করিতে হইবে । রাজা চোখ টিপিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তার পরে ?” “নিবেদন করি মহারাজ । (ফর্নাণ্ডিজ র্তাহার কোর্তার বোতাম খুলিতে লাগিলেন ও পরিতে লাগিলেন ।) আজ দিন তিন-চার ধরিয়া সেনাপতি মহাশয়ের ঘরে রাত্রে চোর আনাগোনা করিতেছিল । সাহেবের ব্ৰাহ্মণী জানিতে পারিয়া কর্তাকে অনেক ঠেলা ঠেলি করেন, কিন্তু কোনোমতেই কর্তার ঘুম ভাঙাইতে পারেন নাই ।” রাজা । হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ! মন্ত্রী । হােঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হােঃ । সেনাপতি । হিঃ হিঃ । “দিনের বেলা গৃহিণীর নিগ্ৰহ আর সহিতে না পারিয়া জোড়হস্তে কহিলেন, ‘দোহাই তোমার, আজ রাত্রে চাের ধরিব।” রাত্রি দুই দণ্ডের সময় গৃহিণী বলিলেন, “ওগো, চাের আসিয়াছে।” কর্তা বলিলেন, “ঐ যাঃ, ঘরে যে আলো জ্বলিতেছে । চোর যে আমাদের দেখিতে পাইবে ও দেখিতে পাইলেই পলাইবে।” চোরকে ডাকিয়া কহিলেন, ‘আজ তুই বড়ো বঁচিয়া গেলি। ঘরে আলো আছে, আজ