পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ꮤ2ᏔᏯO রবীন্দ্র-রচনাবলী এমন সময়ে বসন্ত রায় জোর করিয়া বিভাকে টানিয়া ঘরের মধ্যে আনিয়া হাজির করিলেন । চিবুক ধরিয়া তাহার মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “দেখো দাদা, আজ একবার তোমাদের বিভার মুখখানি দেখো । সুরমা, ও সুরমা, একবার দেখে যাও । আনন্দে গদগদ হইয়া বৃদ্ধ হাসিতে লাগিলেন । বিভাব মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আহলাদ হয় তো ভালো করেই হাস-না ভাই, দেখি । হাসিরে পায়ে ধরে রাখিবি কেমন করে, । হাসির সে প্ৰাণের সাধ ওই অধরে খেলা করে । বয়স যদি না যাইত তো আজ তোর ঐ মুখখানি দেখিয়া এইখানে পড়িতাম আর মরিতাম | হায়, হয়। মরিবার বয়স গিয়াছে। যৌবনকালে ঘড়ি ঘড়ি মরিতাম। বুড়াবয়সে রোগ না হইলে আর মরণ হত্যু की |” প্রতাপাদিত্যকে যখন তাহার শ্যালক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “জামাই বাবাজিকে অভ্যর্থন করিবার জন্য কে গিয়াছে ?” তিনি কহিলেন, “আমি কী জানি ৷” “আজ পথে অবশ্য আলো দিতে হইবে ?” নেত্ৰ বিস্ফারিত করিয়া মহারাজ কহিলেন, “অবশ্যই দিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই ।” তখন রাজশ্যালক সসংকোচে কহিলেন, “নহবত বসিবে নাকি ?” “ সে-সকল বিষয় ভাবিবার অবসর নাই ।” আসল কথা, বাজনা বাজাইয়া একটা জামাই ঘরে আনা প্রতাপাদিত্যের কার্য নহে । রামচন্দ্র রায়ের মহা অভিমান উপস্থিত হইয়াছে ! তিনি স্থির করিয়াছেন তাহাকে ইচ্ছাপূর্বক অপমান করা হইয়াছে। পূর্বে দুই-এক বার তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইয়া যাইবার জন্য রাজবাটী হইতে চকদিহিতে লোক প্রেরিত হইত, এবারে চকদিহি পার হইয়া দুই ক্রোশ আসিলে পর বামনহাটিতে দেওয়ানজি তাহাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিয়াছেন । যদি বা দেওয়ানজি আসিলেন, তাহার সহিত দুই শত পঞ্চাশজন বৈ লোক আসে নাই । কেন, সমস্ত যশোহরে কি আর-পঞ্চাশজন লোক মিলিল না । রাজাকে লইতে যে হাতিটি আসিয়াছে রামাই ভাড়ের মতে স্থূলকায় দেওয়ানজি তাহার অপেক্ষা বৃহত্তর । দেওয়ানকে রামাই জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “মহাশয়, উটি বুঝি আপনার কনিষ্ঠ ?” ভালোমানুষ দেওয়ানজি, ঈষৎ বিস্মিত হইয়া উত্তর দিয়াছেন, “না, ওটা হাতি ।” রাজা ক্ষুব্ধ হইয়া দেওয়ানকে কহিলেন, “তোমাদের মন্ত্রী যে হাতিটাতে চড়িয়া থাকে সেটাও যে ইহা অপেক্ষা বড়ো ।” দেওয়ান কহিলেন, “বড়ো হাতিগুলি রাজকাৰ্য উপলক্ষে দূরে পাঠানাে হইয়াছে, শহরে একটিও নাই ।” রামচন্দ্ৰ স্থির করিলেন, তাহাকে অপমান করিবার জন্যই তাঁহাদের দূরে পাঠানো হইয়াছে। নহিলে আর কী কারণ থাকিতে পারে । রাজাধিরাজ রামচন্দ্র রায় আরক্তিম হইয়া শ্বশুরের নাম ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন, “প্ৰতাপাদিত। রামাই ভাড় কহিল, “বয়সে আর সম্পর্কে, নইলে আর কিসে ? তাহার মেয়েকে যে আপনি বিবাহ করিয়াছেন। ইহাতেই-” কাছে রামমোহন মাল দাড়াইয়া ছিল, তাহার আর সহ্য হইল না, বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিল, “দেখো ঠাকুর, তোমার বড়ো বাড় বাড়িয়াছে! আমার মা-ঠাকরুনের কথা অমন করিয়া বলিয়ো না ! এই স্পষ্ট কথা বলিলাম।” প্রতাপাদিত্যকে লক্ষ্য করিয়া রামাই কহিল, “আমন ঢের ঢের আদিত্য দেখিয়াছি । জানেন তো মহারাজ, আদিত্যকে যে-ব্যক্তি বগলে ধরিয়া রাখিতে পারে, সে-ব্যক্তি রামচন্দ্রের দাস ।” রাজা মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিলেন । রামমোহন তখন ধীরপদক্ষেপে রাজার সম্মুখে আসিয়া জোড়হস্তে কহিল, “মহারাজ, ঐ বামনা যে আপনার শ্বশুরের নামে যাহা ইচ্ছা তাই বলিবে, ইহা তো আমার সহ্য হয় না । বলেন তো উহার মুখ বন্ধ করি।”