পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট V8S প্ৰকাশ করিতেছে না | সীতারামের অন্যান্য গলগ্রহের সঙ্গে শখটিও বজায় আছে, সেটি ধারের উপর বর্ধিত হইতেছে, সুদও যে-পরিমাণে পুষ্ট হইতেছে, সেও সেই পরিমাণে পুষ্ট হইয়া উঠিতেছে। উদয়াদিত্য সীতারামের দারিদ্র্যদশা শুনিয়া তাহার ও ভাগবতের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করিয়া দিলেন । অবধি সে নিজের কাছে ও উদয়াদিত্যের কাছে নিতান্ত অপরাধী হইয়া আছে । উদয়াদিত্যের টাকা পাইয়া সে কাদিয়া ফেলিল। একদিন যুবরাজের সাক্ষাৎ পাইয়া তাহার পা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে ভগবান, জগদীশ্বর, দয়াময় সম্বোধন করিয়া বিস্তর ক্ষমা চাহিল । ভাগবত লোকটা অত্যন্ত ঠাণ্ডা প্রকৃতির। সে শতরঞ্জ খেলে, তামাক খায় ও প্রতিবেশীদিগকে স্বৰ্গনরকের জমি বিলি করিয়া দেয় । সে যখন উদয়াদিত্যের টাকা পাইল, তখন মুখ বাকাইয়া নানা ভাবভঙ্গিতে জানাইল যে যুবরাজ তাহার যে সর্বনাশ করিয়াছেন এ টাকাতে তাহার কী প্ৰতিশোধ হইবে । টাকাটা লইতে সে কিছুমাত্র আপত্তি করিল না । যুবরাজ কর্মচ্যুত প্রহরীদ্বয়কে মাসিক বৃত্তি দিতেছেন, এ কথা প্রতাপাদিত্যের কানে গৈল । আগে হইলে যাইত না । আগে তিনি উদয়াদিত্যকে এত অবহেলা করিতেন যে, উদয়াদিত্য সম্বন্ধে সকল কথা তাহার কানে যাইত না | মহারাজ জানিতেন যে, উদয়াদিত্য প্রজাদের সহিত মিশিতেন, এবং অনেক সময়ে প্রজাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছেন, কিন্তু সেগুলি প্ৰায় এমন সামান্য ও এমন অল্পে অল্পে তাহা তাহার সহিয়া আসিয়াছিল যে, বিশেষ একটা কিছু না হইলে উদয়াদিত্যের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাহার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারিত না | এইবার উদয়াদিত্যের প্রতি তাহার একটু বিশেষ মনোযোগ পড়িয়াছে, তাই উপরি-উক্ত ঘটনাটি অবিলম্বে তাহার কানে গেল । শুনিয়া প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন । উদয়াদিত্যকে ডাকাইয়া আনিলেন ও কহিলেন, “আমি যে সীতারামকে ও ভাগবতকে কর্মচ্যুত করিলাম, সে কি কেবল রাজকোযে তাহাদের বেতন দিবার উপযুক্ত অর্থ ছিল না বলিয়া ? তবে যে তুমি নিজের হইতে তাহাদের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ উদয়াদিত্য ধীরে ধীরে কহিলেন, “আমি দোষী । আপনি তাহদের দণ্ড দিয়া আমাকে দণ্ডিত করিয়াছেন । আমি আপনার সেই বিচার-অনুসারে মাসে মাসে তাঁহাদের নিকট দণ্ড দিয়া থাকি ৷” ইতিপূর্বে কখনােই প্রতাপাদিত্যকে উদয়াদিত্যের কথা মনােযোগ দিয়া শুনিতে হয় নাই । উদয়াদিত্যের ধীর গভীর বিনীত স্বর ও র্তাহার সুসংযত কথাগুলি প্রতাপাদিত্যের নিতান্ত মন্দ লাগিল না | উদয়াদিত্যের কথার কোনো উত্তর না দিয়া প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “আমি আদেশ করিতেছি উদয়, ভবিষ্যতে তাহাদের যেন আর অর্থসাহায্য না করা হয় ।” উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমার প্রতি আরো গুরুতর শাস্তির আদেশ হইল।” হাত জোড় করিয়া কহিলেন, “কিন্তু এমন কী অপরাধ করিয়াছি, যাহাতে এতবড়ো শাস্তি আমাকে বহন করিতে হইবে ? আমি কী করিয়া দেখিব, আমার জন্য আট-নয়টি ক্ষুধিত মুখে অন্ন জুটিতেছে না, আট-নয়টি হতভাগা নিরাশ্রয় হইয়া পথে পথে কঁাদিয়া বেড়াইতেছে, অথচ আমার পাতে অন্নের অভাব নাই ? পিতা, আমার যাহা-কিছু সব আপনারই প্ৰসাদে । আপনি আমার পাতে আবশ্যকের অধিক অন্ন দিতেছেন, কিন্তু আপনি যদি আমার আহারের সময় আমার সম্মুখে আট-নয়টি ক্ষুধিত কাতরকে বসাইয়া রাখেন, অথচ তাহাদের মুখে অন্ন তুলিয়া দিতে বাধা দেন, তবে সে অন্ন যে আমার বিষ ।” । উত্তেজিত উদয়াদিত্যকে প্রতাপাদিত্য কথা কহিবার সময় কিছুমাত্র বাধা দিলেন না, সমস্ত কথা শেষ হইলে পর আস্তে আস্তে কহিলেন, “তোমার যা বক্তব্য তাহা শুনিলাম, এক্ষণে আমার যা বক্তব্য তাহা বলি। ভাগবত ও সীতারামের বৃত্তি আমি বন্ধ করিয়া দিয়াছি, আর কেহ যদি তাঁহাদের বৃত্তি নির্ধারণ করিয়া দেয়, তবে সে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারী বলিয়া গণ্য হইবে ।” প্রতাপাদিত্যের মনে মনে বিশেষ একটু রোষের উদয় হইয়াছিল । সম্ভবত তিনি নিজেও তাহার কারণ বুঝিতে পারেন নাই, কিন্তু তাহার কারণ এই “আমি যেন ভারি একটা নিষ্ঠুরতা করিয়াছি, তাই দয়ার শরীর উদয়াদিত্য তাহার