পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V99O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যুক্ত ধ বিনীতভাবে কহিল, "জনাব, আমাদের মহারাজের নিকট হইতে আদেশ লইয়া "ן যুবরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী আদেশ ।” যুবরাজ পড়িয়া কহিলেন, “ইহার জন্য এত সৈন্যের প্রয়োজন কী ? আমাকে একখানা পত্র লিখিয়া আদেশ করিলেই তো আমি যাইতাম। আমি তো আপনিই যাইতেছিলাম, যাইব বলিয়াই স্থির করিয়াছি। তবে আর বিলম্বে প্রয়োজন কী ? এখনই চলো । এখনই যশোহরে ফিরিয়া যাই ।” মুক্তিয়ার খ্যা হাত জোড় করিয়া কহিল, “এখনই ফিরিতে পারিব না।” যুবরাজ ভীত হইয়া কহিলেন, “কেন ?” মুক্তিয়ার খ্যা কহিল, “আর-একটি আদেশ আছে, তাহা পালন না করিয়া যাইতে পারিব না।” যুবরাজ ভীতস্বরে কহিলেন, “কী আদেশ !” মুক্তিয়ার খ্যা কহিল, “রায়গড়ের রাজার প্রতি মহারাজা প্ৰাণদণ্ডের আদেশ করিয়াছেন।” যুবরাজ চমকিয়া উচ্চস্বরে কহিয়া উঠিলেন, “না, করেন নাই, মিথ্যা কথা ।” মুক্তিয়ার খ্যা কহিল, “আজ্ঞা যুবরাজ, মিথ্যা নহে। আমার নিকট মহারাজের স্বাক্ষরিত পত্ৰ আছে ।” যুবরাজ সেনাপতির হাত ধরিয়া ব্যগ্ৰ হইয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার খা, তুমি ভুল বুঝিয়াছ। মহারাজ । আদেশ করিয়াছেন যে, যদি উদয়াদিত্যকে না পাও, তাহা হইলে বসন্ত রায়ের- আমি যখন আপনি ধরা দিতেছি তখন আর কী ! আমাকে এখনই লইয়া চলো, এখনই লইয়া চলো- আমাকে বন্দী করিয়া লইয়া চলো, আর বিলম্ব করিয়ো না ।” যুবরাজ অধীর হইয়া কহিলেন, “তুমি নিশ্চয়ই ভুল বুঝিয়াছ। র্তাহার অভিপ্ৰায় এরূপ নহে। আচ্ছা! চলো, যশোহরে চলো । আমি মহারাজের সম্মুখে তোমাদের বুঝাইয়া দিব, তিনি যদি দ্বিতীয় বার আদেশ করেন, তবে আদেশ সম্পন্ন করিয়ো ।” মুক্তিয়ার জোড়হন্তে কহিল, “যুবরাজ, মার্জনা করুন, তাহা পারিব না।” যুবরাজ অধিকতর অধীর হইয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার, মনে আছে, আমি এক কালে সিংহাসন পাইব ? আমার কথা রাখো, আমাকে সন্তুষ্ট করো ।” যুবরাজের মুখ পাংশুবৰ্ণ হইয়া গেল, তাহার কপালে ঘর্মবিন্দু দেখা দিল । তিনি সেনাপতির হাত দৃঢ়ভাবে ধরিয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার খা, বৃদ্ধ নিরপরাধ পুণ্যাত্মাকে বধ করিলে নরকেও তোমার স্থান হইবে না ।” মুক্তিয়ার খ্যা কহিল, “মনিবের আদেশ পালন করিতে পাপ নাই।” উদয়াদিত্য উচ্চৈঃস্বরে কহিয়া উঠিলেন, “মিথ্যা কথা । যে ধর্মশাস্ত্ৰে তাহা বলে, সে ধর্মশাস্ত্র মিথ্যা। নিশ্চয়ই জানিয়ো মুক্তিয়ার, পাপ আদেশ পালন করিলে পাপ ।” মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাড়াইয়া রহিল। উদয়াদিত্য চারি দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, “তবে আমাকে ছাড়িয়া দাও । আমি গড়ে ফিরিয়া যাই । তোমার সৈন্যসামন্ত লইয়া সেখানে যাও, আমি তোমাকে যুদ্ধে আহবান করিতেছি । সেখানে রণক্ষেত্রে জয়লাভ করিয়া তার পরে তোমার আদেশ পালন করিয়ো ।” মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাড়াইয়া রহিল। সৈন্যগণ অধিকতর ঘেষিয়া আসিয়া যুবরাজকে ঘিরিল | যুবরাজ কোনো উপায় না দেখিয়া সেই অন্ধকারে প্রাণপণে চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “দাদামহাশয়, সাবধান ।” বন কঁপিয়া উঠিল, মাঠের প্রান্তে গিয়া সে সুর মিলাইয়া গেল । সৈন্যেরা আসিয়া উদয়াদিত্যকে ধরিল । উদয়াদিত্য আর-একবার চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “দাদামহাশয়, সাবধান ।”