পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vod NR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তখন বসন্ত রায় কঁাদিয়া বলিয়া উঠিলেন, “খা সাহেব, আমি প্রতাপকে নিজের হাতে মানুষ করিয়াছি।” কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, অবশেষে আবার কহিলেন, “প্ৰতাপ যখন এতটুকু ছিল আমি তাহাকে দিনরাত কোলে করিয়া থাকি,তাম, সে আমাকে একমুহূর্ত ছাড়িয়া থাকিতে চাহিত না । সেই প্রতাপ বড়ো হইল, তাহার বিবাহ দিয়া দিলাম, তাহাকে সিংহাসনে বসাইলাম, তাহার সন্তানদের কোলে লইলাম— সেই প্ৰতাপ আজ স্বহস্তে এই লেখা লিখিয়াছে খা সাহেব ?” মুক্তিয়ার খ্যার চােখের পাতা ভিজিয়া আসিল, সে অধােবদনে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। বসন্ত রায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাদা কোথায় ? উদয় কোথায় ?” • হইয়াছেন ।” বসন্ত রায় বলিয়া উঠিলেন, “উদয় বন্দী হইয়াছে ? বন্দী হইয়াছে খা সাহেব ? আমি একবার তাহাকে কি দেখিতে পাইব না ?” বসন্ত রায় সাশ্রুনেত্ৰে মুক্তিয়ার খ্যার হাত ধরিয়া কহিলেন, “একবার আমাকে দেখিতে দিবে না খা । সাহেব !” মুক্তিয়ার কহিল, “আমি আদেশপালক ভূত্য মাত্র।” বসন্ত রায় গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “এ সংসারে কাহারও দয়ামায়া নাই, এসো সাহেব, তোমার আদেশ পালন করে ।” করিবেন— আমি প্রভুর আদেশ পালন করিতেছি মাত্র, আমার কোনো দোষ নাই ।” বসন্ত রায় কহিলেন, “না সাহেব, তোমার দোষ কী ? তোমার কোনো দোষ নাই । তোমাকে আর মার্জনা করিব কী ?” বলিয়া মুক্তিয়ার খ্যার কাছে গিয়া তাহার সহিত কোলাকুলি করিলেন ; কহিলেন, সময় তোমার উপরেই উদয়ের ভার দিয়া গেলাম । সে নিরপরাধ- দেখিয়ো অন্যায় বিচারে সে যেন আর কষ্ট না পায় ।” বলিয়া বসন্ত রায় চােখ বুজিয়া ইষ্টদেবতার নিকট ভূমিষ্ঠ হইয়া রহিলেন, দক্ষিণ হস্তে মালা জপিতে লাগিলেন ও কহিলেন, “সাহেব, এইবার ।” মুক্তিয়ার খ্যা ডাকিল, “আবদুল ।” আবদুল মুক্ত তলোয়ার হস্তে আসিল । মুক্তিয়ার মুখ ফিরাইয়া সরিয়া গেল। মুহুর্ত পরেই রক্তাক্ত আসি। হস্তে আবদুল গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিল । গৃহে রক্তস্রোত বহিতে লাগিল । চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ মুক্তিয়ার খ্যা ফিরিয়া আসিল । রায়গড়ে অধিকাংশ সৈন্য রাখিয়া উদয়াদিত্যকে লইয়া তৎক্ষণাৎ যশোহরে যাত্ৰা করিল। পথে যাইতে দুইদিন উদয়াদিত্য খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করিলেন না, কাহারও সহিত একটি কথাও কহিলেন না, কেবল চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। পাষাণমূর্তির ন্যায় স্থির— তাহার নেত্ৰে নিদ্রা নাই, নিমেষ নাই, অশ্রু নাই, দৃষ্টি নাই— কেবলই ভাবিতেছেন । নীেকায় উঠিলেন, নৌকা হইতে মুখ বাড়াইয়া জলের দিকে চাহিয়া রহিলেন, নীেকা চলিতে লাগিল— দাড়ের শব্দ শুনিতে লাগিলেন, জলের কল্লোল কানে প্রবেশ করিল। তবুও কিছু শুনিলেন না, কিছুই দেখিলেন না, কেবলই ভাবিতে লাগিলেন । রাত্ৰি হইল, আকাশে তারা উঠিল, মাঝিরা নীেকা বাধিয়া রাখিল, নৌকায় সকলেই ঘুমাইল । কেবল জলের শব্দ শুনা যাইতেছে, নীেকার উপর ছোটাে ছোটাে তরঙ্গ আসিয়া আঘাত