পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Գ \Ն) রবীন্দ্র-রচনাবলী হইয়া উঠিল— দুর্গের মধ্যে যেন উনপঞ্চাশ বায়ু এবং চৌষট্টি ভূতে একত্র বাসা করিয়াছে। গোবিন্দমাণিক্য এই-সকল উপকরণ লইয়া ধৈর্য ধরিয়া মানুষ গড়িতে লাগিলেন । একটি মানুষের জীবন যে কত মহৎ ও কী প্রাণপণ যত্নে পালন ও রক্ষা করিবার দ্রব্য, তাহা গোবিন্দমাণিক্যের হৃদয় সর্বদা জাগরূক। র্তাহার চারিদিকে অনন্তফলপরিপূর্ণ মনুষ্যজন্ম সার্থক হয়, ইহাই দেখিয়া এবং নিজের চেষ্টায় ইহাই সাধন করিয়া গোবিন্দমাণিক্য নিজের অসম্পূর্ণ জীবন বিসর্জন করিতে চান। ইহার জন তিনি সকল কষ্ট সকল উপদ্রব সহ্য করিতে পারেন । কেবল মাঝে মাঝে এক-একবার হতাশ্বাস হইয় দুঃখ করিতেন, “আমার কার্য আমি নিপুণরূপে সম্পন্ন করিতে পারিতেছি না। বিন্ধন থাকিলে ভালো হইত ।” এইরূপে গােবিন্দমাণিক্য এক শত ধ্রুবকে লইয়া দিনযাপন করিতে লাগিলেন। ত্রিচক্র্যারিংশ পরিচ্ছেদ স্টুয়ার্ট-কৃত বাংলার ইতিহাস হইতে এই পরিচ্ছেদ সংগৃহীত এ দিকে শা সুজা তাহার ভ্রাতা ঔরংজীবের সৈন্য-কর্তৃক তড়িত হইয়া পলায়ন করিতেছেন। এলাহাবাদের নিকট যুদ্ধক্ষেত্রে তাহার পরাজয় হয় । বিপক্ষ পরাক্রান্ত, এবং এই বিপদের সময় সুজা স্বপক্ষীয়দেরও বিশ্বাস করিতে পারিলেন না । তিনি অপমানিত ও ভীত ভাবে ছদ্মবেশে সামানা লোকের মতো একাকী পলায়ন করিতে লাগিলেন। যেখানেই যান পশ্চাতে শত্রুসৈন্যের ধূলিধ্বজ ও তাহাদের অশ্বের ক্ষুরধ্বনি র্তাহাকে অনুসরণ করিতে লাগিল। অবশেষে পাটনায় পৌঁছিয়া তিনি পুনর্বাের নবাব-বেশে আপন পরিবার ও প্রজাদের নিকটে আগমনসংবাদ ঘোষণা করিলেন । তিনিও যেমন পাটনায় পৌছিলেন, তাহার কিছু কাল পরেই ঔরংজীবের পুত্ৰ কুমার মহম্মদ সৈন্য-সহিত পাটনার দ্বারে আসিয়া পৌছিলেন । সুজা পাটনা ছাড়িয়া মুঙ্গেরে পলাইলেন । মুঙ্গেরে তাহার বিক্ষিপ্ত দলবল কতক কতক তাহার নিকট আসিয়া জুটিল এবং সেখানে তিনি নূতন সৈন্যও সংগ্ৰহ করিলেন । তেরিয়াগড়ি ও শিকলিগলির দুর্গ সংস্কার করিয়া এবং নদীতীরে পাহাড়ের উপরে প্রাচীর নির্মাণ করিয়া তিনি দৃঢ় হইয়া বসিলেন । এ দিকে ঔরংজীব। তাহার বিচক্ষণ সেনাপতি মীরজুমলাকে কুমার মহম্মদের সাহায্যে পাঠাইলেন। কুমার মহম্মদ প্রকাশ্য ভাবে মুঙ্গেরের দুর্গের অনতিদূরে আসিয়া শিবির স্থাপন করিলেন, এবং মীরজুমলা অন্য গােপন পথ দিয়া মুঙ্গের-অভিমুখে যাত্রা করিলেন । যখন সুজা কুমার মহম্মদের সহিত ছোটােখাটাে যুদ্ধে ব্যাপৃত আছেন, এমন সময় সহসা সংবাদ পাইলেন যে, মীরজুমলা বহুসংখ্যক সৈন লইয়া বসন্তপুরে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন । সুজা ব্যস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহার সমস্ত সৈন্য লইয়া মুঙ্গের ছাড়িয়া রাজমহলে পলায়ন করিলেন । সেখানেই তাহার সমস্ত পরিবার বাস করিতেছিল । সম্রাটসৈন্য অবিলম্বে সেখানেও তাহার অনুসরণ করিল। সুজা ছয় দিন ধরিয়া প্ৰাণপণে যুদ্ধ করিয়া শত্রুসৈন্যকে অগ্রসর হইতে দিলেন না । কিন্তু যখন দেখিলেন আর রক্ষা হয় না, তখন একদিন অন্ধকার ঝড়ের রাত্রে তাহার পরিবার-সকল ও যথাসম্ভব ধনসম্পত্তি লইয়া নদী পার হইয়া তোণ্ডায় পলায়ন করিলেন এবং অবিলম্বে সেখানকার দুর্গ-সংস্কারে প্রবৃত্ত হইলেন । এই সময়ে ঘনবর্ষা আসিল, নদী অত্যন্ত স্ফীত এবং পথ দুৰ্গম হইয়া উঠিল । সম্রাটসৈন্যেরা অগ্রসর হইতে পারিল না । - এই যুদ্ধবিগ্রহের পূর্বে কুমার মহম্মদের সহিত সুজার কন্যার বিবাহের সমস্ত স্থির হইয়াছিল । কিন্তু এই যুদ্ধের উপদ্রবে। সে প্রস্তাব উভয় পক্ষই বিস্মৃত হইয়াছিল। বর্ষায় তখন যুদ্ধ স্থগিত আছে এবং মীরজুমলা রাজমহল হইতে কিছু দূরে তাহার শিবির লইয়া গেছেন, এমন সময় সুজার একজন সৈনিক তোণ্ডার শিবির হইতে আসিয়া গোপনে কুমার মহম্মদের হস্তে একখানি পত্ৰ দিল। কুমার খুলিয়া দেখিলেন সুজার কন্যা লিখিতেছেন- “কুমার, এই কি আমার