পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

vパり8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তোমাদের কালের সবই ভালো, আমাদের কালের সবই মন্দ, এইটে তুমি প্রমাণ করিতে চাও। এ সম্বন্ধে আমার দু-একটা কথা বলিবার আছে, তাহাতে যদি তোমাদের আদব-কায়দার কোনো ব্যতিক্রম হয় তবে আমাকে মাপ করিতে হইবে । আমরা যাহা করি তাহা তোমাদের চক্ষে বেয়াদবি বলিয়া ঠেকে, এইজন্যই ভয় হয় । তোমরা চোখে কম দেখ, কিন্তু নাতিদের একটি সামান্য ত্রুটি চশমা না লইয়াও বেশ দেখিতে পাও । n যে লোক যে কালে জন্মগ্রহণ করে সে কালের প্রতি তাহার যদি হৃদয়ের অনুরাগ না থাকে। তবে সে কালের উপযোগী কাজ সে ভালো করিয়া করিতে পারে না । যদি সে মনে করে, “যে কাল গেছে তাহাই ভালো আর আমাদের কাল অতি হেয়’, তবে তাহার কাজ করিবার বল চলিয়া যায় ; ভূতকালের দিকে শিয়ার করিয়া সে কেবল স্বপ্ন দেখে ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে এবং ভূতত্ব প্রাপ্ত হওয়াই সে একমাত্র বাঞ্ছনীয় মনে করে । স্বদেশ যেমন একটা আছে স্বকালও তেমনি একটা আছে। স্বদেশকে ভালো না বাসিলে যেমন স্বদেশের কাজ করা যায় না, তেমনি স্বকালকে ভালো না বাসিলে স্বকালের কাজও করা যায় না। যদি ক্রমাগতই স্বদেশের নিন্দা করিতে থাক, স্বদেশের কোনাে গুণই দেখিতে না পাও, তবে স্বদেশের উপযোগী কাজ তোমার দ্বারা ভালোরূপে সম্পন্ন হইতে পারে না । কেবলমাত্র কর্তব্য বিবেচনা করিয়া তুমি স্বদেশের উপকার করিতে চেষ্টা করিতে পারো, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয় না । তোমার হৃদয়হীন কাজগুলো বিদেশী বীজের মতো স্বদেশের জমিতে ভালো করিয়া অঙ্কুরিত হইতে পারে না । তেমনি স্বকালের যে কেবল দোষই দেখে, কোনো গুণ দেখিতে পায় না, সে চেষ্টা করিলেও স্বকালের কাজ ভালো করিয়া করিতে পারে না । এক হিসাবে সে নাই বলিলেও হয় ; সে জন্মায় নাই, সে অতীতকালে জন্মিয়াছে, সে অতীতকালে বাস করিতেছে ; এ কালের জনসংখ্যার মধ্যে তাহাকে ধরা যায় না। ঠাকুরদাদামশায়, তুমি যে তোমাদের কালকে ভালোবাস এবং ভালো বল, সে তোমার একটা গুণের মধ্যে । ইহাতে বুঝা যাইতেছে তোমাদের কালের কর্তব্য তুমি করিয়াছ । তুমি তোমার বাপ-মাকে ভক্তি করিয়াছ, তোমার পাড়াপ্রতিবেশীদের বিপদে-আপদে সাহায্য করিয়াছ, শাস্ত্ৰমতে ধর্মকর্ম করিয়াছ, দানধান করিয়াছ, হৃদয়ের পরম পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছ। যেদিন আমরা আমাদের কর্তব্য কাজ করি, সেদিনের সূর্যালোক আমাদের কাছে উজ্জ্বলতর বলিয়া বোধ হয়, সেদিনের সুখস্মৃতি বহুকাল ধরিয়া আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সেকালের কাজ তোমরা শেষ করিয়াছ, অসম্পূর্ণ রাখ নাই, সেইজন্য আজ এই বৃদ্ধ বয়সে অবসরের দিনে সেকালের স্মৃতি এমন মধুর বলিয়া বোধ হইতেছে। কিন্তু তাই বলিয়া একালের প্রতি আমাদের বিরাগ জন্মাইবার চেষ্টা করিতেছ। কেন ? ক্রমাগতই একালের নিন্দা করিয়া একালের কাছ হইতে আমাদের হৃদয় কড়িয়া লাইবার চেষ্টা করিতেছ। কেন ? আমাদিগের জন্মভূমি এবং আমাদের জন্মকাল এই দুয়ের উপরেই আমাদের অনুরাগ অটল থাকে এই আশীর্বাদ করো। গঙ্গোত্রীর সহিত গঙ্গার অবিচ্ছিন্ন সহস্রধারে যোগ রক্ষা হইতেছে বটে, কিন্তু তাই বলিয়া গঙ্গা প্ৰাণপণ চেষ্টা করিয়াও পিছু হঠিয়া গঙ্গোত্রীর উপরে আর উঠিতে পারে না । তেমনি, তোমাদের কাল ভালোই হউক আর মন্দই হউক, আমরা কোনোমতেই ঠিক সে জায়গায় যাইতে পারিব না । এটা যদি নিশ্চয় হয় তবে সাধ্যাতীতের জন্য নিৰ্ম্মফল বিলাপ ও পরিতাপ না করিয়া যে অবস্থায় জন্মিয়াছি তাহারই সহিত বনিবনাও করিয়া লওয়াই ভালো । ইহার ব্যাঘাত যে করে সে অনেক অমঙ্গল সৃষ্টি করে । বর্তমানের প্রতি অরুচি ইহা প্রায়ই বর্তমানের দোষে হয় না, আমাদের নিজের অসম্পূর্ণতাবশত হয়, আমাদের হৃদয়ের গঠনের দোষে হয় । বর্তমানই আমাদের বাসস্থান এবং কার্যক্ষেত্র । কার্যক্ষেত্রের প্ৰতি যাহার অনুরাগ নাই সে ফাকি দিতে চায়। যথার্থ কৃষক আপনার চাষের জমিটুকুকে প্রাণের মতো ভালোবাসে, সেই জমিতে সে শস্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম বপন করে। আর, যে কৃষক কাজ করিতে চায় না, ফাকি দিতে চায়, নিজের জমিতে পা দিলে তাহার পায়ে যেন কঁাটা ফুটিতে থাকে, সে কেবলই খুঁত খুঁত করিয়া বলে- “আমার জমির এ দোষ, সে দোষ, আমার জমিতে কঁাকর, আমার জমিতে কঁাটগাছ ইত্যাদি । নিজের ছাড়া আর সকলের জমি দেখিলেই তাহার চোখ জুড়াইয়া যায়।