পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brどかど。 রবীন্দ্র-রচনাবলী WS) ভায়া, দাদামহাশয়দের সঙ্গে ঠাট্টােতামাশা করিতে পাও বলিয়া যে তাহাদের ভক্তি করিতে হইবে না, এটা কোনো কাজের কথা নহে। দাদামহাশয়েরা তোমাদের চেয়ে এত, বেশি বড়ো যে তাহাদের সঙ্গে ঠাট্টােতামাশা করিলেও চলে। কেমনতরো জানো ? যেমন ছোটাে ছেলে বাপের গায়ে পা তুলিয়া দিলে তাহাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না । কিন্তু তাহা হইতে এমন প্ৰমাণ হয় না যে, বাপের প্রতি সেই ছোটো ছেলের ভক্তি নাই, অর্থাৎ নির্ভরের ভাব নাই, অর্থাৎ সে সহজেই বাপকে আপনার চেয়ে বড়ো মনে করে না । তোমরা তেমনি আমাদের কাছে এত ছোটো যে, আমরা নিরাপদে তোমাদের সহিত বেয়াদবি করিতে পারি এবং অকাতরে তোমাদের বেয়াদবি সহিতে পারি। আর-একটা কথা, সন্তানের শুভাশুভ সমস্তই পিতার উপর নির্ভর করিতেছে, এইজন্য স্বভাবতই পিতার স্নেহের সহিত শাসন আছে এবং পুত্রের ভক্তির সহিত ভয় আছে— পদে পদে কঠোর কর্তব্যপথে সন্তানকে নিয়োগ করিবার জন্য পিতার আদেশ করিতে হয় এবং পুত্রের তাহা পালন করিতে হয়, এইজন্য পিতাপুত্রের মধ্যে আচরণের শৈথিল্য শোভা পায় না । এইরূপে পিতার উপরে কঠোর মেহের ভার দিয়া দাদামহাশয় কেবলমাত্ৰ মধুর স্নেহ বিতরণ করেন এবং নাতি নিৰ্ভয় ভক্তিভারে দাদামহাশয়ের সহিত আনন্দে । হাস্যালাপ করিতে থাকে । কিন্তু সে হাস্যালাপের মর্মের মধ্যে যদি ভক্তি না থাকে। তবে তাহা বেয়াদবির অধম । এত কথা তোমাকে বলিবার আবশ্যক ছিল না, কিন্তু তোমার লেখার ভঙ্গি দেখিয়া তোমাকে কিঞ্চিৎ সাবধান করিয়া দিতে হয় । বাস রে ! আজিকাল তোমরা এত কথাও কহিতে শিখিয়াছ ! এখন একটা কথা কহিলে পাঁচটা কথা শুনিতে হয় । তাহার মধ্যে যদি সব কথা বুঝিতে পারিতাম তাহা হইলেও এতটা গায়ে লাগিত না । ভাবের মিল থাকিলেও অনেক সময়ে আমরা পরস্পরের ভাষা বুঝিতে পারি না বলিয়া বিস্তর মনান্তর উপস্থিত হয় । আমি বুড়ামানুষ, তোমার সমস্ত কথা ঠিক বুঝিয়াছি কি না কে জানে, কিন্তু যেরূপ বুঝিলাম সেইরূপ উত্তর দিতেছি । স্বকাল, পরকাল, এ এক নূতন কথা তুমি তুলিয়াছ। পরকালটা নূতন নয়, সমুখের একজোড়া দাত বিসর্জন দিয়া অবধি ঐ কালের কথাটাই ভাবিতেছি- কিন্তু স্বকাল আবার কী ? কালের কি কিছু স্থিরতা আছে না কি ? আমরা কি ভাসিয়া যাইবার জন্য আসিয়াছি যে কালস্রোতের উপর হাল ছাড়িয়া দিয়া বসিয়া থাকিব ? মহৎ মনুষ্যত্বের আদর্শ কি স্রোতের মধ্যবর্তী শৈলের মতো কালকে অতিক্রম করিয়া বিরাজ করিতেছে না ? আমরা পরিবর্তনের মধ্যে থাকি বলিয়াই একটা স্থির লক্ষ্যের প্রতি বেশি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক । নহিলে কিছুক্ষণ বাদে আর-কিছুই ঠাহর হয় না ; নাহিলে আমরা পরিবর্তনের দাস হইয়া পড়ি, পরিবর্তনের খেলনা হইয়া পড়ি । তুমি যেরূপ লিখিয়াছ তাহাতে তুমি পরিবর্তনকেই প্ৰভু বলিয়াছ, কালকেই কর্তা বলিয়া মানিয়াছ। অর্থাৎ, ঘোড়াকেই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়াছ এবং আরোহীকেই তাহার অধীন বলিয়া প্রচার করিতেছ। কালের প্রতি ভক্তি এইটেই তুমি সার কথা ধরিয়া লইয়াছ, কিন্তু মনুষ্যত্বের প্রতি- ধ্রুব আদর্শের প্রতি— ভক্তি তাহা অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ । মনুষ্যের প্রতি প্ৰেম, পিতার প্রতি ভক্তি, পুত্রের প্রতি স্নেহ- এ যে কেবল পরিবর্তনশীল ক্ষুদ্র কালবিশেষের ধর্ম এ কথা বলিতে কে সাহস করে ! এ ধর্ম সকল কালের উপরেই মাথা তুলিয়া আছে। উনবিংশ শতাব্দীর ধূলি উড়াইয়া ইহাকে চােখের আড়াল করিতে পারো, তাই বলিয়া ফুয়ের জোরে ইহাকে একেবারে ধূলিসাৎ করিতে পারো না । যদি সত্যই এমন দেখিয়া থাকো যে, এখনকার কালে পিতামাতাকে কেহ ভক্তি করে না, অতিথিকে কেহ যত্ন করে না, প্ৰতিবেশীদিগকে কেহ সাহায্য করে না, তবে এখনকার কালের জন্য শোক করোকালের দোহাই দিয়া অধৰ্মকে ধর্ম বলিয়া প্রচার করিয়ো না । ।