পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

trዒ O রবীন্দ্র-রচনাবলী আমরা আশা করিয়া আছি ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে এ-সকল সংকীর্ণতা ক্ৰমে আমাদের মন হইতে দূর হইয়া যাইবে । এই শিক্ষার প্রতি বিরাগ জন্মাইয়া দিয়া ইহার অভ্যন্তরস্থিত ভালো জিনিসটুকু দেখিবার পথ রুদ্ধ করিয়া দেওয়া আমাদের পক্ষে মঙ্গলজনক বলিয়া বোধ হয় না । সেবক শ্ৰীনবীনকিশোর শর্মণঃ চিরঞ্জীবেষু তোমার চিঠি পড়িয়া বড়ো খুশি হইলাম। বাস্তবিক, বাঙালিজাতি যেরূপ চালাকি করিতে শিখিয়াছে তাহাতে তাহদের কাছে কোনো গভীর বিষয় বলিতে বা কোনো শ্ৰদ্ধাস্পদের নাম করিতে মনের মধ্যে সংকোচ উপস্থিত হয় । আমাদের এক কালে গৌরবের দিন ছিল, আমাদের দেশে এক কালে বড়ো বড়ো বীর সকল জন্মিয়াছিলেন— কিন্তু বাঙালির কাছে ইহার কোনো ফল হইল না । তাহারা কেবল ভীষ্ম-দ্ৰোণ-ভীমাৰ্জনকে পুরাতত্ত্বের কুলুঙ্গি হইতে পাড়িয়া, ধূলা ঝাড়িয়া, সভাস্থলে পুতুল নাচ দেখায়। আসল কথা, ভীষ্ম প্রভৃতি বীরগণ আমাদের দেশে মরিয়া গিয়াছেন । তাহারা যে বাতাসে ছিলেন সে বাতাস এখন আর নাই। স্মৃতিকে বাচিতে হইলেও তাহার খোরাক চাই । নাম মনে করিয়া রাখা তো স্মৃতি নহে, প্ৰাণ ধরিয়া রাখাই স্মৃতি । কিন্তু প্ৰাণ জাগাইয়া রাখিতে হইলেই তাহার উপযোগী বাতাস চাই, তাহার উপযোগী খাদ্য চাই । আমাদের হৃদয়ের তপ্ত রক্ত সেই স্মৃতির শিরার মধ্যে প্রবাহিত হওয়া চাই । মনুষ্যত্বের মধ্যেই ভীষ্ম-দ্ৰোণ বঁাচিয়া আছেন । আমরা তো নকল মানুষ } অনেকটা মানুষের মতো । ঠিক মানুষের মতো খাওয়াদাওয়া করি, চলিয়া ফিরিয়া বেড়াই, হাই তুলি ও ঘুমোই— দেখিলে কে বলিবে যে মানুষ নই! কিন্তু ভিতরে মনুষ্যত্ব নাই । যে জাতির মজ্জার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে সে জাতির কেহ মহত্ত্বকে অবিশ্বাস করিতে পারে না, মহৎ আশাকে কেহ গাজাখুরি মনে করিতে পারে না, মহৎ অনুষ্ঠানকে কেহ হুজুক বলিতে পারে না । সেখানে সংকল্প কার্য হইয়া উঠে, কার্য সিদ্ধিতে পরিণত হয় ; সেখানে জীবনের সমস্ত লক্ষণই প্ৰকাশ পায় ! সে জাতিতে সৌন্দর্য ফুলের মতো ফুটিয়া উঠে, বীরত্ব ফলের মতো পক্কতা প্রাপ্ত হয় । আমার বিশ্বাস, আমরা যতই মহত্ত্ব উপার্জন করিতে থাকিব, আমাদের হৃদয়ের বল যতই বাড়িয়া উঠিবে, আমাদের দেশের বীরগণ ততই পুনজীবন লাভ করিবেন । পিতামহ ভীষ্ম আমাদের মধ্যে র্বাচিয়া উঠিবেন । আমাদের সেই নূতন জীবনের মধ্যে আমাদের দেশের প্রাচীন জীবন জীবন্ত হইয়া উঠিবে। নতুবা মৃত্যুর মধ্যে জীবনের উদয় হইবে কী করিয়া ? বিদ্যুৎপ্ৰয়োগে মৃতদেহ জীবিতের মতো কেবল অঙ্গভঙ্গি ও মুখভঙ্গি করে মাত্র । আমাদের দেশে সেই বিচিত্র ভঙ্গিমার প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। কিন্তু হায় হায়, কে আমাদিগকে এমন করিয়া নাচাইতেছে ? কেন আমরা ভুলিয়া যাইতেছি যে আমরা নিতান্ত অসহায় ? আমাদের এত-সব উন্নতির মূল কোথায় ? এ-সব উন্নতি রাখিব কিসের উপরে ? রক্ষা করিব কী উপায়ে ? একটু নাড়া খাইলেই দিন-দুয়ের সুখস্বপ্নের মতো সমস্তই যে কোথায় বিলীন হইয়া যাইবে ! অন্ধকারের মধ্যে ইংরাজি ফ্যাশানে করতালি দিতেছি । উন্নতির চাকচিক্য লাভ করিয়াছি কিন্তু উন্নতিকে ধারণ করিবার, পোষণ করিবার ও রক্ষা করিবার বিপুল বল কই লাভ করিতেছি ? আমাদের হৃদয়ের মধ্যে চাহিয়া দেখো, সেখানে সেই জীৰ্ণতা, দুর্বলতা, অসম্পূর্ণতা, ক্ষুদ্রতা, অসত্য, অভিমান, অবিশ্বাস, ভয় । সেখানে চপলতা, লঘুতা, আলস্য, বিলাস । দৃঢ়তা নাই, উদ্যম নাই ; কারণ, সকলেই মনে করিতেছেন, সিদ্ধি হইয়াছে, সাধনার আবশ্যক নাই । কিন্তু যে সিদ্ধি সাধনা-ব্যতীত হইয়াছে তাহাকে কেহ বিশ্বাস করিয়ো না । তাহাকে তোমার বলিয়া মনে করিতেছি, কিন্তু সে কখনোই তোমার নহে । আমরা