Š) Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রেমের মধ্যে একটা সীমাতীত লোকাতীত ঐশ্বৰ্য অনুভব করিয়াছে। ক্ষিতি কহিল— সীমার মধ্যে অসীম, প্রেমের মধ্যে অনন্ত, এ-সব কথা যতই বেশি শুনি ততই বেশি দুর্বোিধ হইয়া পড়ে। প্রথম প্রথম মনে হইত যেন কিছু কিছু বুঝিতে পারিতেছি। বা, এখন দেখিতেছি অনন্ত অসীম প্রভৃতি শব্দগুলা স্তুপাকার হইয়া বুঝিবার পথ বন্ধ করিয়া দাড়াইয়াছে। আমি কহিলাম— ভাষা ভূমির মতো । তাঁহাতে একই শস্য ক্রমাগত বপন করিলে তাহার উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হইয়া যায়। ‘অনন্ত’ এবং “অসীম' শব্দ-দুটা আজকাল সর্বদা ব্যবহারে জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে, এইজন্য যথার্থই একটা কথা বলিবার না থাকিলে ও-দুটা শব্দ ব্যবহার করা উচিত হয় না। মাতৃভাষার প্রতি একটু দয়ামায়া করা কর্তব্য । ক্ষিতি কহিল- ভাষার প্রতি তোমার তো যথেষ্ট সদয় আচরণ দেখা যাইতেছে না । সমীর এতক্ষণ আমার খাতাটি পড়িতেছিল, শেষ করিয়া কহিল- এ কী করিয়াছ ! তোমার ডায়ারির এই লোকগুলা কি মানুষ না যথার্থই ভূত ? ইহারা দেখিতেছি। কেবল বড়ো বড়ো ভালো ভালো কথাই বলে, কিন্তু ইহাদের আকার-আয়তন কোথায় গেল । আমি বিষগ্নমুখে কহিলাম— কেন বলে দেখি । সমীর কহিল— তুমি মনে করিয়াছ, আম্রের অপেক্ষা আমসত্ত্ব ভালো, তাহাতে সমস্ত আঁঠি আঁশ আবরণ এবং জলীয় অংশ পরিহার করা যায়— কিন্তু তাহার সেই লোভন গন্ধ, “সেই শোভন আকার কোথায় ? তুমি কেবল আমার সারটুকু লোককে দিবে, আমার মানুষটুকু কোথায় গেল । আমার বেবাক বাজে কথাগুলো তুমি বাজেয়াপ্ত করিয়া যে-একটি নিরেট মূর্তি দাড় করাইয়ােছ তাহাতে দন্তস্ফুট করা দুঃসাধ্য। আমি কেবল দুই-চারিটি চিন্তাশীল লোকের কাছে বাহবা পাইতে চাহি না, আমি সাধারণ লোকের মধ্যে বঁচিয়া থাকিতে চাহি । আমি কহিলাম— সেজন্য কী করিতে হইবে ? সমীর কহিল- সে আমি কী জানি । আমি কেবল আপত্তি জানাইয়া রাখিলাম । আমার যেমন সার আছে তেমনি আমার স্বাদ আছে ; সারাংশ মানুষের পক্ষে আবশ্যক হইতে পারে, কিন্তু স্বাদ মানুষের নিকট প্ৰিয় । আমাকে উপলক্ষ করিয়া মানুষ কতকগুলো মত কিংবা তর্ক আহরণ করিবে এমন ইচ্ছা! করি না, আমি চাই মানুষ আমাকে আপনার লোক বলিয়া চিনিয়া লইবে । এই ভ্ৰমসংকুল সাধের মানবজন্ম ত্যাগ করিয়া একটা মাসিক পত্রের নির্ভুল প্ৰবন্ধ-আকারে জন্মগ্রহণ করিতে আমার প্রবৃত্তি হয় না । আমি দার্শনিক তত্ত্ব নই, আমি ছাপার বই নাই, আমি তর্কের সুযুক্তি অথবা কুযুক্তি নই, আমার ব্যোম এতক্ষণ একটা চৌকিতে ঠেসান দিয়া আর-একটা চৌকির উপর পা-দুটা তুলিয়া অটল প্ৰশান্ত ভাবে বসিয়াছিল । সে হঠাৎ বলিল— তর্ক বলো, তত্ত্ব বলো, সিদ্ধান্ত এবং উপসংহারেই তাহাদের চরম গতি ; সমাপ্তিতেই তাহাদের প্রধান গৌরব । কিন্তু মানুষ স্বতন্ত্রজাতীয় পদার্থঅমরতা অসমাপ্তিই তাহার সর্বপ্রধান যথার্থ্য । বিশ্রামহীন গতিই তাহার প্রধান লক্ষণ । অমরতা কে সংক্ষেপ করিবে ? গতির সারাংশ কে দিতে পারে ? ভালো ভালো পাকা কথাগুলি যদি অতি অনায়াস-ভাবে মানুষের মুখে বসাইয়া দাও, তবে ভ্রম হয় তাহার মনের যেন একটা গতিবৃদ্ধি নাই— তাহার যতদূর হইবার শেষ হইয়া গেছে। চেষ্টা ভ্ৰম অসম্পূর্ণতা পুনরুক্তি যদিও আপাতত দারিদ্র্যের মতো দেখিতে হয়, কিন্তু মানুষের প্রধান ঐশ্বর্য তাহার দ্বারাই প্রমাণ হয় । তাহার দ্বারা চিন্তার একটা গতি, একটা জীবন, নির্দেশ করিয়া দেয় । মানুষের কথাবার্তা চরিত্রের মধ্যে কঁচা রঙটুকু, অসমাপ্তির কোমলতা দুর্বলতাটুকু, না রাখিয়া দিলে তাহাকে একেবারে সাঙ্গ করিয়া ছোটাে করিয়া ফেলা হয় । তাহার অনন্ত পর্বের পালা একেবারে সূচীপত্রেই সারিয়া দেওয়া হয় । সমীর কহিল—— মানুষের ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা অতিশয় অল্প ; এইজন্য প্রকাশের সঙ্গে নির্দেশ, ভাষার সঙ্গে ভঙ্গি, ভাবের সহিত ভাবনা যোগ করিয়া দিতে হয় । কেবল রথী নহে, রথের মধ্যে তাহার গতি সঞ্চারিত করিয়া দিতে হয় । যদি একটা মানুষকে উপস্থিত কর, তাহাকে খাড়া দাড় করাইয়া