পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত &8 ○ কাহারও সমালোচনা করিবার কোনো অধিকার নাই- কারণ, আমরা উত্তম মধ্যম অধম সকলেই খাটাে ধুতি ও ময়লা চাদর পরিয়া নিৰ্গুণ ব্রহ্মে লয় পাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বসিয়া আছি। হেনকালে ব্যোম তাহার বৃহৎ লগুড়খানি হাতে করিয়া আসিয়া উপস্থিত । তাহার বেশ অন্য দিনের অপেক্ষাও অদ্ভুত ; তাহার কারণ, আজ ক্রিয়াকর্মের বাড়ি বলিয়াই তাহার প্রাত্যহিক বেশের উপরে বিশেষ করিয়া একখানা অনির্দিষ্ট-আকৃতি চাপকন গোছের পদার্থ চাপাইয়া আসিয়াছে ; তাহার আশপাশ হইতে ভিতরকার অসংগত কাপড়গুলার প্রান্ত স্পষ্ট দেখা যাইতেছে- দেখিয়া আমাদের হাস্য সংবরণ করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল এবং দীপ্তি ও স্রোতস্বিনীর মনে যথেষ্ট অবজ্ঞার উদয় হইল । ব্যোম জিজ্ঞাসা করিল- তোমাদের কী বিষয়ে আলাপ হইতেছে ? সমীর আমাদের আলোচনার কিয়দংশ সংক্ষেপে বলিয়া কহিল- আমরা দেশসুদ্ধ সকলেই বৈরাগ্যের ‘ভেক ধারণ করিয়াছি। ব্যোম কহিল— বৈরাগ্য ব্যতীত কোনো বৃহৎ কর্ম হইতেই পারে না । আলোকের সহিত যেমন ছায়া, কর্মের সহিত তেমনি বৈরাগ্য নিয়ত সংযুক্ত হইয়া আছে। যাহার যে পরিমাণে বৈরাগ্যে অধিকার পৃথিবীতে সে সেই পরিমাণে কাজ করিতে পারে। ক্ষিতি কহিল— সেইজন্য পৃথিবীসুদ্ধ লোক যখন সুখের প্রত্যাশায় সহস্ৰ চেষ্টায় নিযুক্ত ছিল তখন বৈরাগী ডারুয়িন সংসারের সহস্ৰ চেষ্টা পরিত্যাগ করিয়া কেবল প্রমাণ করিতেছিলেন যে, মানুষের আদিপুরুষ বানর ছিল। এই সমাচারটি আহরণ করিতে ডারুয়িনকে অনেক বৈরাগ্য সাধন করিতে श्ट्रेशछिब्ल । ব্যোম কহিল- বহুতর আসক্তি হইতে গারিবান্ডি যদি আপনাকে স্বাধীন করিতে না পারিতেন। তবে ইটালিকেও তিনি স্বাধীন করিতে পারিতেন না । যে-সকল জাতি কনিষ্ঠ জাতি তাহারাই যথার্থ বৈরাগ্য জানে। যাহারা জ্ঞানলাভের জন্য জীবন ও জীবনের সমস্ত আরাম তুচ্ছ করিয়া মেরুপ্রদেশের হিমশীতল মৃত্যুশালার তুষারারুদ্ধ কঠিন দ্বারদেশে বারংবার আঘাত করিতে ধাবিত হইতেছে, যাহারা ধর্মবিতরণের জন্য নরমাংসভুক রাক্ষসের দেশে চিরনির্বাসন বহন করিতেছে, যাহারা মাতৃভূমির আহবানে মুহুর্তকালের মধ্যেই ধনজনযৌবনের সুখশয্যা হইতে গাত্ৰোত্থান করিয়া দুঃসহ ক্লেশ এবং অতি নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে ঝাপ দিয়া পড়ে, তাহারাই জানে যথার্থ বৈরাগ্য কাহাকে বলে। আর আমাদের এই কর্মহীন শ্ৰীহীন নিশ্চেষ্ট নিজীব বৈরাগ্য কেবল অধঃপতিত জাতির মূৰ্ছাবস্থামাত্ৰ- উহা জড়ত্ব, উহা অহংকারের বিষয় নহে । ক্ষিতি কহিল—আমাদের এই মূৰ্ছাবস্থাকে আমরা আধ্যাত্মিক দশা পাওয়ার অবস্থা মনে করিয়া নিজের প্রতি নিজে ভক্তিতে বিহবল হইয়া বসিয়া আছি । ব্যোম কহিল— কমীকে কর্মের কঠিন নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়, সেইজন্যেই সে আপন কর্মের নিয়মপালন উপলক্ষে সমাজের অনেক ছোটো কর্তব্য উপেক্ষা করিতে পারে- কিন্তু অকৰ্মণ্যের সে অধিকার থাকিতে পারে না। যে লোক তাড়াতাড়ি আপিসে বাহির হইতেছে তাহার নিকটে সমাজ সুদীর্ঘ সুসম্পূর্ণ শিষ্টালাপ প্রত্যাশা করে না । ইংরাজ মালী যখন গায়ের কোর্তা খুলিয়া হাতের আস্তিন গুটািইয়া বাগানের কাজ করে তখন তাহাকে দেখিয়া তাহার অভিজাতবংশীয়া প্ৰভু মহিলার লজ্জা পাইবার কোনো কারণ নাই। কিন্তু আমরা যখন কোনো কাজ নাই, কর্ম নাই, দীর্ঘ দিন রাজপথপাৰ্থে নিজের গৃহদ্বারপ্রান্তে স্থূল বর্তুল উদর উদঘাটিত করিয়া, হাঁটুর উপর কাপড় গুটািইয়া, নির্বোধের মতো তামাক টানি, তখন বিশ্বজগতের সম্মুখে কোন মহৎ বৈরাগ্যের কোন উন্নত আধ্যাত্মিকতার দোহাই দিয়া এই কুশ্রী বর্বরতা প্রকাশ করিয়া থাকি ! যে বৈরাগ্যের সঙ্গে কোনো মহত্তর সচেষ্ট সাধনা সংযুক্ত নাই তাহা অসভ্যতার নামান্তর মাত্র । ব্যোমের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া স্রোতস্বিনী আশ্চর্য হইয়া গেল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া । বলিল- আমরা সকল ভদ্রলোকেই যত দিন না। আপন ভদ্রত রক্ষার কর্তব্য সর্বদা মনে রাখিয়া আপনাদিগকে বেশে ব্যবহারে বাসস্থানে সর্বতোভাবে ভদ্র করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিব তত দিন আমরা