পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ԳԵ- রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রকৃতি সম্বন্ধে, মকুন্য সম্বন্ধে, ঘটনা সম্বন্ধে, কবি যখন নিজের আনন্দ বিষাদ বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং তাহার নিজের সেই মনোভাব কেবলমাত্র আবেগের দ্বারা ও রচনাকৌশলে অন্যের মনে সঞ্চারিত করিয়া দিবার চেষ্টা করেন তখন র্তাহাকে কেহ অপরাধী করে না । তখন পাঠকও অহমিকাসহকারে কেবল এইটুকু দেখেন যে “কবির কথা আমার মনের সহিত মিলিতেছে কি না । কাব্যসমালোচকও যদি যুক্তিতর্ক এবং শ্রেণীনির্ণয়ের দিক ছাড়িয়া দিয়া কাব্যপাঠজাত মনোভাব পাঠকগণকে উপহার দিতে উদ্যত হন তবে সেজন্য র্তাহাকে দোষী করা উচিত হয় না । বিশেষত আজ আমি যে কথা স্বীকার করিতে বসিয়াছি তাহার মধ্যে আত্মকথার কিঞ্চিৎ অংশ থাকিতেই হইবে । ছেলেভুলানে ছড়ার মধ্যে আমি যে রসাস্বাদ করি, ছেলেবেলাকার স্মৃতি হইতে তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব । সেই ছড়াগুলির মাধুর্য কতটা নিজের বাল্যস্মৃতির এবং কতটা সাহিত্যের চিরস্থায়ী আদর্শের উপর নির্ভর করিতেছে তাহ নির্ণয় করিবার উপযুক্ত বিশ্লেষণশক্তি বর্তমান লেখকের নাই। এ কথা গোড়াতেই কবুল করা ভালো । ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর, নদী এল বান’ এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মতো ছিল এবং সেই মোহ এথনো অামি ভুলিতে পারি নাই । আমি আমার সেই মনের মুগ্ধ অবস্থা স্মরণ করিয়া না দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারিব না ছড়ার মাধুর্ঘ এবং উপযোগিতা কী । বুঝিতে পারিব না, কেন এত মহাকাব্য এবং খণ্ডকাব্য, এত তত্ত্বকথা এবং নীতিপ্রচার, মানবের এত প্রাণপণ প্রযত্ন, এত গলদঘর্ম ব্যায়াম— প্রতিদিন ব্যর্থ এবং বিস্মৃত হইতেছে, অথচ এই-সকল অসংগত অর্থহীন যদৃচ্ছাকৃত শ্লোকগুলি লোকস্মৃতিতে চিরকাল প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে। এই-সকল ছড়ার মধ্যে একটি চিরত্ব আছে । কোনোটির কোনো কালে কোনো রচয়িত ছিল বলিয়া পরিচয় মাত্র নাই এবং কোন শকের কোন তারিখে কোনটা রচিত হইয়াছিল এমন প্রশ্নও কাহারও মনে উদয় হয় না। এই স্বাভাবিক চিরত্বগুণে ইহারা আজ রচিত হইলেও পুরাতন এবং সহস্ৰ বৎসর পূর্বে রচিত হইলেও নূতন । ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর-কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্রথা অনুসারে বয়স্ক মানবের কত নূতন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত সহস্ৰ বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। সেই অপরিবর্তনীর পুরাতন বারম্বার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে, অথচ সর্বপ্রথম দিন লে যেমন নবীন, যেমন স্বকুমার, যেমন মূঢ়, যেমন মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে।