পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা (2br& অন্তত আধুনিক মনের কাছে শ্রেষ্ঠ শ্রেণীর simplicity-র আবেদনের চেয়ে ঢের বেশি সাড়া পায়। সুরকে সরল করে গাওয়াকে আমি যে কারণেই হোক কখনো মনে প্ৰাণে ভালোবাসতে পারি নি, যেমন বেসে এসেছি তার মধ্যে স্বরবিন্যাসের কলাকারুকে, নানান অনুভূতির আলোছায়ার বিচিত্র সমাবেশকে, সুরকে লীলোচ্ছলভাবে উৎসাহিত করে তুলতে পারাকে- এক কথায় স্বরসম্পদ সৃষ্টিতে উদ্দাম প্রেরণাকে। l. আমি কবিকে শুধু বললাম, “এ কথাটাকে আমি ভালো করে ভেবে দেখব। তাই, এখন আপনার এ মতটির সম্বন্ধে কোনো আলোচনা না করে কেবল আপনাকে এইটুকুমাত্র বলে রাখতে চাই যে, আমার এই অনুভূতিটি খুবই গভীর যে সুরসম্পদ যথাযথ ভাবে বাড়ালে তাতে করে গানের রস নিবিড়তরাই হয়ে ওঠে। এটা আমি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোধ হয় প্রমাণ করতে পারি।” । কবি বললেন, “কিরকম ?” আমি বললাম, ‘ধরুন, যেমন পিতৃদেবের এ জীবনে পূরিল না। সাধ” বা ‘মলয় আসিয়া’ গানে। আমি আমার অনেক সুকুমারহাদয় বন্ধুর কাছে। এ গানদুটি একটু সুরের নিবিড় ব্যঞ্জনার মধ্যে গেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছি।” কবি বললেন, ‘যেটা হয়েছে সেটা হয়েছে এই সহজ কথা অস্বীকার করব কেন ? যদি পূর্বপ্রচলিত কোনো বাধা নিয়মের সঙ্গে সেই হওয়াটা না মেলে, তা হলে বলব নিয়মটা ছিল সংকীর্ণ। কিংবা হয়তো এমনও বলতে পারি নিয়মটা ভাঙা হয়েছে বলে যে প্রতীয়মান হচ্ছে সেটাই ভুল। কিন্তু, সেইসঙ্গে এ কথা ভুললেও চলবে না যে, ব্যক্তিবিশেষের আনন্দ পাওয়াকেই এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নিস্পত্তি বলে মেনে নেওয়া চলে না। রসসৃষ্টি করতেও যেমন সহজ শক্তির দরকার, রসের দরদ বোধ সম্বন্ধেও তেমনি সহজ শক্তি। রসের মূল্যনির্ধারণ মাথাগনতি ভোটের দ্বারা হয় না। রসিক ও রসের সাধকদের কাছে বিধান নিতে হয়, শিক্ষা নিতে হয়। যার সহজ রসবোধ আছে তার কোনো বালাই নেই।” : আমি বললাম, তাই, যাঁরা শুধু কাব্য-অনুরাগী তাদের আমিও বলি যে, সুরসম্পদকে বাড়ালে গানের রস নিবিড় হল না নিস্তপ্ৰভ হল। এ সম্বন্ধে তাদের বিচার ভালো লােগা না-লাগাই প্রামাণ্য নয়, যেহেতু তঁরা বরাবর গানকে বেশি কাব্য-ঘেষা করে দেখার দরুন সুরসম্পদবৈচিত্র্যের যথার্থমূল্য নির্ধারণ করবার অস্তর দৃষ্টিটি অর্জন করেন নি। এ ক্ষেত্রে শুধু সুর বোঝেন এমন লোকের রায়ও যেমন সন্তোষজনক হতে পারে না, শুধু কাব্য বোঝেন এমন লোকের রায়ও তেমন নির্ভরযোগ্য হতে পারে না। আমাদের যেতে হবে তঁদের কাছে যাঁরা কমবেশি দুইয়েরই রসজ্ঞ। কবি বললেন, “তোমার এই তর্কের মধ্যে ব্যক্তিগত বিশেষ ঘটনার ইঙ্গিত আছে, সুতরাং এটা তর্কের ক্ষেত্রের বাইরে। অর্থাৎ এখানে মতের বিচার ছড়িয়ে বাক্তির বিচার এসে পড়ল, অথচ ব্যক্তিটি রইল অগোচরে। বোঝা যাচ্ছে গান সম্বন্ধে কোনো-কোনো মানুষের সঙ্গে তোমার মতের মিল হয় না, তুমি যাদের সরাসরি ভাবে কাব্য-ঘেষা বলে জরিমানা করতে চাও ; অথচ, তাদের হাতে যদি বিচারভার থাকে তা হলে তারাও তোমাকে বিশেষণ মাত্রের দ্বারা লাঞ্ছিত করতে পারে। কিন্তু, বিশেষণ তো বিচাের নয়। "আজকের আলোচনার কথাটা এই যে, আমি যে-সব গান রচনা করি তাতে সুরের যথেষ্ট প্রাচুর্য নেই বলে তোমার ভালো লাগে না। তুমি তার উপরে নিজের ইচ্ছামতো প্রাচুর্য আরোপ করে গাইতে চাও। তার পরে যদি সেটা কারো ভালো না লাগে। তবে তার কপালে কাব্য-ঘেষা ইপি মেরে গীতরসিক সভা থেকে বরখাস্ত করে দেবার বিধান তোমার।