পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/৩২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

বিজয়ার সর্বাগ্রে মনে হইয়াছিল, কাল প্রভাতেই সে যেমন করিয়া হোক কলিকাতায় পলাইয়া এই ব্যাধের ফাঁদ হইতে আত্মরক্ষা করিবে। কিন্তু, উত্তেজনার প্রথম ধাক্কাটা যখন কাটিয়া গেল, তখন দেখিতে পাইল তাহাতে জালের ফাঁসি যে শুধু বেশী করিয়া চাপিয়া বসিবে তাই নয়, অপবাদের ধুয়া সঙ্গে সঙ্গে বহিয়া সেখানকার আকাশ পর্যন্ত কলুষিত করিতে বাকী রাখিবে না। তখন কলিকাতার সমাজেই বা সে মুখ দেখাইবে কি করিয়া? অথচ, এখানেও সে ঘরের বাহির হইতে পারিল না। যদিচ নিশ্চয় বুঝিতেছিল রাসবিহারী তাহাকে পরিত্যাগ করিবার জন্য নয়, বরঞ্চ গ্রহণ করিবার অভিপ্রায়েই এই দুর্নামের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, এবং একান্ত নিরাশ না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই বাহিরে এ মিথ্যা প্রচার করিবেন না, তবুও দিন-দুই পরে কাছারির গোমস্তা যখন হিসাব সই করাইতে বিজয়ার দর্শন প্রার্থনা করিল, তখন সে অসুস্থতার ছুতা করিয়া চাকরকে দিয়া খাতাপত্র উপরে চাহিয়া আনাইল। আজ নিজের কর্মচারীকেও দেখা দিতে তাহার লজ্জা করিতে লাগিল পাছে কোন ছিদ্র দিয়া এ কথা তাহার কানে গিয়া থাকে, এবং তাহার চক্ষেও অবজ্ঞা ও উপহাসের দৃষ্টি লুকাইয়া থাকে।

একটা জিনিস সে যেমন ভয় করিতেছিল তেমনি প্রাণ দিয়া কামনা করিতেছিল—তাহার পিতার পত্র লইয়া নরেন নিজেই উপস্থিত হইবে। কিন্তু দিন পাঁচ-ছয় পরে সে সমস্যার মীমাংসা হইয়া গেল পিয়নের হাত দিয়া। চিঠি আসিল বটে, কিন্তু সে ডাকে। নরেন নিজে আসিল না। কেন যে সে আসিল না তাহা অনুমান করিতে তাহার মুহূর্ত বিলম্ব হইল না। সে ঠিক এই আশঙ্কাই করিতেছিল পাছে রাসবিহারী কোন ছলে এ কথা নরেনের কর্ণগোচর করিয়া তাহার এ বাটীর পথ রুদ্ধ করিয়া দেন। চিঠি হাতে করিয়া বিজয়া ভাবিতে লাগিল। কিন্তু, এত সহজেই যদি এ দিকের পথ তাহার রুদ্ধ হইয়া যায়, এমনি অনায়াসে সেও যদি এই মিথ্যা কলঙ্কের ডালি তাহারি মাথায় তুলিয়া দিয়া সভয়ে সরিয়া দাঁড়ায়, তাহা হইলে এ দুর্নামের বোঝা—তা সে যত বড় মিথ্যাই হোক—সে বহিয়া বেড়াইবে কোন্‌ অবলম্বনে? তখন এই মিথ্যা ভারই যে পরম সত্যের মত তাহাকে ধূলিসাৎ করিয়া দিবে!

এমনি অভিভূতের মত স্থির হইয়া বসিয়া সে যে কত কি চিন্তা করিতে লাগিল তাহার সীমা নাই। তাহার বহুক্ষণ পরে সে উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং এইবার