পাতা:শ্রীকান্ত - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

} শ্ৰীকান্তু পত্র লিখিয়াছিলেন এবং তাহারই প্ৰত্যুত্তরে আমার স্বৰ্গবাসিনী জননী এই গঙ্গাজল-দুহিতার বিবাহের সমস্ত দায়িত্ব গ্ৰহণ করিয়া যে চিঠি লিখিয়াছিলেন, এখানি সেই মূল্যবান দলিল। সাময়িক করুণায় বিগলিত হইয়া মা উপসংহারে লিখিয়াছেন, সুপাত্র আর কোথাও না জোটে, তঁাহার নিজের ছেলে তা আছে । তা বটে ! সংসারে সুপাত্রের যদি-বা একান্ত অভাব হয়, তখন আমি ত আছি । সমস্ত লেখাটা আগাগোড় বার-দুই পড়িয়া দেখিলাম মুন্সিয়ানা আছে বটে ! মার উকিল হওয়া উচিত ছিল। কারণ, যত প্রকারে কল্পনা করা যাইতে পারে, তিনি নিজেকে, মায়। ভঁাহার বংশধরটিকেও দায়িতে বাধিয়া গিয়াছেন। দলিলের কোথাও এতটুকু ত্রুটি বাখিয়া যান নাই । সে যাই হোক, ‘গঙ্গাজল’ যে এই সুদীর্ঘ তেরো বৎসর কাল এই পাকা দলিলটির উপর বাবাত দিয়াই নিশ্চিন্ত নিৰ্ভয়ে নীরবে বসিয়া ছিলেন, তাহা মনে হইল না । বরঞ্চ মনে হইল, বহু চেষ্টা করিয়াও অর্থ ও লোকাভাবে সুপােত্র যখন র্তাহার পক্ষে একেবারেই অপ্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে এবং অনুঢ়া কন্যার শারীরিক উন্নতির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া পুলকে বুকের রক্ত মগজে চড়িবার উপক্ৰম করিয়াছে, তখনই এই হতভাগ্য সুপাত্রের উপর তঁাহার একমাত্ৰ ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ নিক্ষেপ করিয়াছেন। মাতা বঁচিয়া থাকিলে এই চিঠির জন্য আজ তাহার মাথা খাইয়া ফেলিতাম ; কিন্তু এখন, যে উচুতে বসিয়া তিনি হাসিতেছেন, সেখানে লাফ দিয়াও যে তার পায়ের তলায় সজোরে একটা ঢু মারিয়া গায়ের জ্বালা মিটাইব, সে পথও আমার বন্ধ হইয়া গেছে। সুতরাং মায়ের কিছু না করিতে পারিয়া, তঁহার গঙ্গাজলের কি করিতে পারি না-পারি, পরখ করিবার জন্য, একদিন রাত্রে স্টেশনে আসিয়া ‘উপস্থিত হইলাম। সারারাত্রি ট্রেনে কাটাইয়া পরদিন তঁাহার পল্পীভবনে আসিয়া যখন পৌছিলাম, তখন বেলা অপরাহু। গঙ্গাজল-মা প্ৰথমে আমাকে চিনিতে পারিলেন না । শেষে পরিচয় পাইয়া এই তেরো বৎসর পরে এমন কান্নাই কদিলেন যে, মায়ের মৃত্যুকালে তঁহার কোন আপনার লোক চোখের উপর তঁহাকে মরিতে দেখিয়াও এমন করিয়া কঁদিতে পারে নাই।