পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৮৮ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ হৃদয়-দর্পণে ঐ ঘটনার ছায়াপাত হইল। ইহা তাহার জ্ঞানগোচর হইলে, আর গৃহে থাকিতে তাহার ইচ্ছা রহিল না, তিনি নিজ পুত্রদ্বয়কে ডাকিয়া মনোভাব ব্যক্ত করিলেন ও এক মহামহোৎসবের আয়োজন করিতে বলিলেন। পিতৃবাক্য শ্রবণে পুত্রেরা অত্যন্ত অধীর হইয়া পড়িলে তিনি তাহাদিগকে আশ্বাস দিয়া বলিলেন—“আমি সময়ে সময়ে তোমাদিগকে দেখা দিব, তোমরা হরিপদে মনস্থির রাখিয়া স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা নিৰ্ব্বাহ কর।” অদৃশ্য হওয়ার কথা বাণীর অভিপ্রায়মত মহা মহোৎসবের আয়োজন হইল; অবিরত কীৰ্ত্তন চলিতে লাগিল, যখন কীৰ্ত্তনে সকলে মত্ত, তখন হঠাৎ ঠাকুরবাণী অদৃশ্য হইলেন, তাহাকে আর পাওয়া গেল না। পুত্ৰগণ পিতার মৃত্যু কল্পনা করিয়া শোকাভিভূত হইলেন। সেই রাত্রে রাজেন্দ্র স্বপ্নে দেখিলেন, যেন পিতা বলিতেছেন, “রাজেন্দ্র! ভ্রান্তধারণা ছাড়, আমি মরি নাই, আমার শ্ৰাদ্ধ করিও না। তবে লোকনিন্দা পরিহারের জন্য কিছু করা কৰ্ত্তব্য: আমার উদ্দেশে কিছু চিড়া, গুড়, কদলী, দধি ও দুগ্ধ দিও। এসব দ্রব্য গোপালের কাছে ভোগ দিয়া প্রসাদস্বরূপ আমাকে প্রদান করিও; ইহাই যথেষ্ট।” পুত্ৰগণ পিতার শ্ৰাদ্ধ না করিয়া, পিতার উদ্দেশ্যে গোপালের প্রসাদ মাত্র নিবেদন করিয়া দিলেন । কালক্রমে রাজেন্দ্রের হরিরাম নামে একটী পুত্র জাত হয়, জন্মের ৬ষ্ঠ দিনে ষষ্ঠীপূজা উপলক্ষে যখন আত্মীয় স্বজন সকলে সমবেত হইয়াছেন, তখন তাহারা দেখিতে পাইলেন যে এক যোগীপুরুষ ধীরে ধীরে আগমন করিতেছেন। যোগী আর কেহ নহেন—ঠাকুর বাণী । পুত্রেরা এবং অন্যান্য সকলে বহুকাল পরে তাহাকে পাইয়া পরম আনন্দে বসিতে আসন দিলেন; কিন্তু তিনি না বসিয়া সূতিকালয়ে গেলেন। তাহার ইঙ্গিতে বধূ কর্তৃক শিশু তৎসমীপে আনীত হইলে, তিনি শিশুর মাথায় দক্ষিণ পদাঙ্গুষ্ঠ স্থাপন করিয়া হঠাৎ অদৃশ্য হইয়া গেলেন; কোথায় গেলেন, আর কেহ খুঁজিয়া পাইল না। এই হরিরামের পৌত্র, ঠাকুরবাণীর বৃদ্ধ প্রপৌত্র জয়গোবিন্দের মনে হইয়াছিল যে ঠাকুরবাণীর শ্ৰাদ্ধাদি হয় নাই; ইহা শাস্ত্রসঙ্গত নহে এবং তদ্বংশীয়গণের প্রত্যবায় স্বরূপ। এই দীর্ঘকাল মধ্যে অবশ্যই ঠাকুরবাণীর মৃত্যু হইয়া থাকিবে, অতএব গয়াতে গিয়া তাহার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করা কৰ্ত্তব্য। তিনি মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, গয়াতে যাইবেন স্থির করিলেন। প্রকাশ্যে গয়ার কথা কাহাকেও না বলিয়া তীর্থে যাইবেন বলিয়া প্রকাশ করিলেন। এতৎ শ্রবণে তিনজন শিষ্য তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার মানসে পুড়াউন্ধা নামক পাহাড়তলির পথে আসিতে আসিতে পথ ভ্ৰমে বড়ই বিপদগ্ৰস্ত হইলেন; এমন সময়ে তাহারা দেখিতে পাইলেন যে, জটা বঙ্কলধারী এক ঋষি বন হইতে বহির্গত হইয়া তাহাদের সম্মুখীন হইতেছেন, পথিকত্ৰয় বিক্ষিত ও কিঞ্চিৎ ভীত হইয়া স্তম্ভিতপ্রায় হইলেন; তাহাদের গতিশক্তি যেন রহিত হইয়া আসিল, তাহারা ঋষির দিকে চাহিয়া দাড়াইয়া রহিলেন। তাপসের হাতে বিম্বফল (মতান্তরে দাড়িম্বফল); তিনি পথিকদের নিকটে আসিয়া সহাস্যে বলিলেন “পথভ্রষ্ট পথিক, তোমাদের মঙ্গল হউক!" তারপরে দূরে একটি পথের রেখা দেখাইয়া বলিলেন—“এই পথে তোমরা দিনারপুরে যাইতে পরিবে।" হাতের ফলটি একজনকে দিয়া বলিলেন “এই ফলটি জয়গোবিন্দকে দিও; বলিও বাণী মরে নাই, গয়াতে তাহার fণ্ড দেওয়া নিম্প্রয়োজন”! এই বলিয়া মহাপুরুষ পুনঃ পৰ্ব্বতে আরোহণ করিলেন।