পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪২
সংকলন

পৃথিবীতে নেশন গড়ে উঠল সত্যের জোরে; কিন্তু ন্যাশন্যালিজম সত্য নয়, অথচ সেই জাতীয় গণ্ডী-দেবতার পূজার অনুষ্ঠানে চারিদিক থেকে নরবলির যোগান চলতে লাগল। যতদিন বিদেশী বলি জুটত ততদিন কোনো কথা ছিল না, হঠাৎ ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে পরস্পরকে বলি দেবার জন্য স্বয়ং যজমানদের মধ্যে টানাটানি পড়ে গেল। তখন থেকে ওদের মনে সন্দেহ জাগতে আরম্ভ হল,— “একেই কি বলে ইষ্টদেবতা। এ যে ঘর-পর কিছুই বিচার করে না।” এ যখন একদিন পূর্বদেশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোমল অংশ বেছে তাতে দাঁত বসিয়েছিল এবং “ভিক্ষু যথা ইক্ষু খায়, ধরি ধরি চিবায় সমস্ত”—তখন মহাপ্রসাদের ভোজ খুব জমেছিল, সঙ্গে সঙ্গে মদমত্ততারও অবধি ছিল না। আজ মাথায় হাত দিয়ে ওদের কেউ কেউ ভাবছে, এর পূজো আমাদের বংশে সইবে না। যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছিল তখন সকলেই ভাবছিল যুদ্ধ মিটলেই অকল্যাণ মিটবে। যখন মিটল তখন দেখা গেল, ঘুরে ফিরে সেই যুদ্ধটাই এসেছে সন্ধিপত্রের মুখোশ প’রে। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে যার প্রকাণ্ড লেজটা দেখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আঁৎকে উঠেছিল, আজ লঙ্কাকাণ্ডের গোড়ায় দেখি সেই লেজটার উপর মোড়কে মোড়কে সন্ধিপত্রের স্নেহসিক্ত কাগজ জড়ানো চলেছে: বোঝা যাচ্ছে, ঐটাতে আগুন যখন ধরবে তখন কারো ঘরের চাল আর বাকি থাকবে না।—পশ্চিমের মনীষী লোকেরা ভীত হয়ে বলছেন যে, যে-দুর্বুদ্ধি থেকে দুর্ঘটনার উৎপত্তি, এত মারের পরেও তার নাড়ী বেশ তাজা আছে। এই দুর্বুদ্ধিরই নাম ন্যাশন্যালিজ্‌ম্ দেশের সর্বজনীন আত্মম্ভরিতা। এ হল রিপু, ঐক্যতত্ত্বের উলটোদিকে, অর্থাৎ আপনার দিকটাতেই এর টান। কিন্তু, জাতিতে জাতিতে আজ একত্র হয়েছে এই কথাটা যখন অস্বীকার করবার জো নেই, এত বড়ো সত্যের উপর, যখন কোনো একটামাত্র প্রবলজাতি আপন