পাতা:সংগীত চিন্তা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
সংগীতচিন্তা

তাহার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতে থাকে। নিশ্বাসের ছন্দে, হৃদয়ের উত্থান-পতনের ছন্দে, তাহার তাল নিয়মিত হইতে থাকে। কথা বলিতে বলিতে তাহার বাধিয়া যায়, কথার মাঝে মাঝে অশ্রু পড়ে, নিশ্বাস পড়ে, লজ্জা আসে, ভয় হয়, থামিয়া যায়। সরল যুক্তির এমন তাল নাই, আবেগের দীর্ঘনিশ্বাস পদে পদে তাহাকে বাঁধা দেয় না। তাহার ভয় নাই, লজ্জা নাই, কিছুই নাই। এই নিমিত্ত চূড়ান্ত যুক্তির ভাষা গল, চূড়ান্ত অনুভূতির ভাষা পদ্য।

 ইতিপূর্বেই ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হইয়াছে যে, আমাদের ভাবপ্রকাশের দুটি উপকরণ আছে— কথা ও সুর। কথাও যতখানি ভাব প্রকাশ করে, সুরও প্রায় ততথানি ভাব প্রকাশ করে। এমন-কি, সুরের উপরেই কথার ভাব নির্ভর করে। একই কথা নানা স্বরে নানা অর্থ প্রকাশ করে। অতএব ভাবপ্রকাশের অঙ্গের মধ্যে কথা ও সুর উভয়কেই পাশাপাশি ধরা যাইতে পারে। সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভভ্র ভাষায় মিশিয় আমাদের ভাবের ভাষা নির্মাণ করে। কবিতায় আমরা কথার ভাষাকে প্রাধান্য দিই ও সংগীতে সুরের ভাষাকে প্রীধান্ত দিই। যেমন, কথোপকথনে আমরা যে-সকল কথা যেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি কবিতায় আমরা সে-সকল কথা সেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি না, কবিতায় আমরা বাছিয়া বাছিয়া কথা লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি— তেমনি কথোপকথনে আমরা যে-সকল সুর যেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি সংগীতে সে-সকল সুর সেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি না, সুর বাছিয়া বাছিয়া লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি। কবিতায় যেমন বাছা-বাছা সুন্দর কথায় ভাব প্রকাশ করে, সংগীতেও তেমনি বাছা-বাছা সুন্দর সুরে ভাব প্রকাশ করে। যুক্তির ভাষায় প্রচলিত কথোপকথনের সুর ব্যতীত আর-কিছু আবশ্যক করে না, কিন্ত যুক্তির অতীত আবেগের ভাষায় সংগীতের স্বর আবশ্যক করে। এ বিষয়েও সংগীত অবিকল কবিতার ন্যায়। সংগীতেও ছন্দ আছে। তালে তালে তাহার সুরের লীলা নিয়মিত হইতেছে। কথোপকথনের ভাবায় সুশৃঙ্খল ছন্দ নাই, কবিতায় ছন্দ আছে। তেমনি কথোপকথনের সুরে সুশৃঙ্খল তাল নাই, সংগীতে তাল আছে। সংগীত ও কবিতা উভয়ে ভাবপ্রকাশের দুইটি অঙ্গ ভাগাভাগি করিয়া লইয়াছে। তবে, কবিতা ভাবপ্রকাশ সন্বন্ধে যতখানি উন্নতি লাভ করিয়াছে, সংগীত ততখানি করে নাই। তাহার একটি প্রধান কারণ আছে।

২৪