পাতা:সঞ্চয়িতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চিত্রা
২৭৩

সহসা বাজিয়া বাজিয়া উঠিল দশ দিকে বীণা বেণু,
মাথার উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িল পুষ্পরেণু;
দ্বিগুণ আভায় জ্বলিয়া উঠিল দীপের আলোকরাশি—
ঘোমটা-ভিতরে হাসিল রমণী মধুর উচ্চ হাসি।
সে হাসি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল বিজন বিপুল ঘরে—
শুনিয়া চমকি ব্যাকুলহৃদয়ে কহিলাম জোড়করে,
‘আমি যে বিদেশী অতিথি, আমায় ব্যথিয়ো না পরিহাসে-
কে তুমি নিদয় নীরব ললনা কোথায় আনিলে দাসে!’

অমনি রমণী কনকদণ্ড আঘাত করিল ভূমে,
আঁধার হইয়া গেল সে ভবন রাশি রাশি ধূপধূমে।
বাজিয়া উঠিল শতেক শঙ্খ হুলুকলরব-সাথে—
প্রবেশ করিল বৃদ্ধ বিপ্র ধান্যদূর্বা হাতে।
পশ্চাতে তার বাঁধি দুই সার কিরাতনারীর দল
কেহ বহে মালা, কেহ-বা চামর, কেহ-বা তীর্থজল।
নীরবে সকলে দাঁড়ায়ে রহিল—বৃদ্ধ আসনে বসি
নীরবে গণনা করিতে লাগিল গৃহতলে খড়ি কষি।
আঁকিতে লাগিল কত-না চক্র, কত-না রেখার জাল;
গণনার শেষে কহিল, ‘এখন হয়েছে লগ্নকাল।’
শয়ন ছাড়িয়া উঠিলা রমণী বদন করিয়া নত,
আমিও উঠিয়া দাঁড়াইনু পাশে মন্ত্রচালিতমত।
নারীগণ সবে ঘেরিয়া দাঁড়ালো একটি কথা না বলি,
দোঁহাকার মাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি।
পুরোহিত শুধু মন্ত্র পড়িল আশিস করিয়া দোঁহে—
কী ভাষা কী কথা কিছু না বুঝিনু, দাঁড়ায়ে রহিনু মোহে।
অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল, শিহরিয়া কলেবর,
হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর।